পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় খাল-বিল হত্যাকারীদের চিহ্নিত করনে ৭ দফা দাবী
পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহমান খালটি বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এ খালটির চিংগড়িয়া অংশে এখনও ৩-৪ ফুট পানি থাকে। অথচ আরও ৩০ বছর আগে এটি কৃষি জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। খালকে রক্ষা তো দূরের কথা, উল্টো সরকারের ভূমি অফিসের লোকজন খাল-বিল হত্যার জন্য প্রথমত দায়ী রয়েছেন বলে আমরা মনে করছি।
কলাপাড়া উপজেলার সকল খালের সীমানা চিহ্নিতকরণসহ সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা তুলে ধরা হয়।
সোমবার শেষ বিকেল কলাপাড়া পৌর শহরের হ্যালিপ্যাড মাঠে পরিবেশবাদী জাতীয় সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), ওয়াটার্স কিপার্স বাংলাদেশ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আমরা কলাপাড়াবাসীর আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
এসময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর স্থানীয় সমন্বয়কারী মেজবাহ উদ্দিন মাননু। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন কলাপাড়ার সমন্বয়কারী মো. নজরুল ইসলাম, আমরা কলাপাড়াবাসীর সভাপতি নাজমুস সাকিব প্রমুখ।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর স্থানীয় সমন্বয়কারী মেজবাহ উদ্দিন মাননু লিখিত বক্তব্যে বলেন, বিভিন্ন সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে কিছু সংখ্যক খাল পুন:খনন করা হয়েছে। কিন্তু পুন:দখল প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খালপাড়ের কৃষকসহ সাধারণ মানুষের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। নেওয়া হয়নি কৃষি বিভাগের কোনো সুপারিশ।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো পুন:খনন করা হয়নি, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ থাকা খালগুলো খনন করা হয়েছে। এতে সরকারের অর্থ ঠিকই ব্যয় হয়েছে। কিন্তু খালের মিঠা পানির ওপর নির্ভরশীল কৃষকের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা ক্ষতির কবলে পড়েছে।
২০১১ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার উদ্যোগে জরুরি প্রয়োজনে এখানকার ৮৮টি খাল পুনর্খননের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়। ২০১৭ সালের এক সরকারি তথ্যমতে, কলাপাড়ায় লিজযোগ্য ১৪২টি খাল চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ২১ একরের নিচে ১১৫টি খাল রয়েছে। আর ২১ একরের বড় ২৭টি খাল রয়েছে। বড় ২৭টির খালের মোট আয়তন ৮৩০ দশমিক ৫৮ একর। ২৭টি খালের আয়তন দেখানো রয়েছে মোট ১ হাজার ৫৪৬ দশমিক ৫৮ একর।
খাল ভরাট ও দখলের ফলে এখন আর সঠিক তথ্য তহশিল কিংবা ভূমি অফিস সংরক্ষণ করে না। তাঁরা কখনো খালে সীমানা চিহ্নিত করেন না। একটা দায়সারা গোছের মনোভাব রয়েছে তাঁদের। রয়েছে চরম উদাসীনতা।
মেজবাহ উদ্দিন মাননু আরও বলেন, কলাপাড়ার খাল নিয়ে উদাসীনতার একটি বাস্তব উদাহরণ রয়েছে আমাদের কাছে।
কুয়াকাটা পৌরসভার মধ্যে বর্তমানে এই ভরাট খালের অবস্থান। যার সাবেক মৌজা লতাচাপলী। এক নম্বর খাস খতিয়ানে এ খাল অন্তর্ভূক্ত। এস এ দাগ নম্বর ৪৭৫৬ ও ৪৭৫৭, এর জমির পরিমাণ দেড় একর। এটি মাঝিবাড়ি এলাকার একটি খাল ছিল। নবোদয় হাউজিং নামের একটি আবাসন কোম্পানি ভরাট করে খালটি দখলে নিয়েছে।
কিন্তু আজ পর্যন্ত এই সরকারি খালটি উদ্ধারে কার্যকর কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি। কলাপাড়া ও কুয়াকাটা পৌরসভার খাল দুটি দখল-দূষণ-ভরাটে অস্তিত্ব সংকটে পড়লেও এটি রক্ষায় সরকারি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখছি না।
তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, কৃষি উৎপাদন ও এই জনপদের মানুষের জীবন-সম্পদ রক্ষায় জলোচ্ছ্বাসসহ লবন পানির ছোবল ঠেকাতে ষাটের দশকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নদীর পাড় ঘেঁষে বন্যানিয়ন্ত্রণবাঁধ নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া বাঁধের ভিতরের খালের সঙ্গে জলকপাট নির্মাণ করা হয়। যাতে কৃষক তাঁর সুবিধামতো সময় পানি তুলবে এবং জলাবদ্ধতা নিরসন করবেন।
যদিও বর্তমানে এর একটি বিরুপ প্রতিক্রিয়া এখন দেখা দিয়েছে। জোয়ার-ভাটায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। জমি চাষাবাদের ফলে সৃষ্ট পলিতে বন্যানিয়ন্ত্রনবাঁধের অভ্যন্তরের খালগুলো ক্রমশ ভরাট হয়ে গেছে।
আর এই সুযোগে জমির মালিকরা ভরাট অংশ দখল করে খালকে চাষের জমিতে পরিণত করেছেন। এসব খালকে আবার আশির দশকের সময় চাষযোগ্য কৃষি জমি দেখিয়ে ভূমি অফিস থেকে বন্দোবস্ত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বন্দোবস্ত গ্রহিতারা ভরাট খালের ওই জমিতে বাঁধ দিয়ে পুকুর, ঘর-বাড়ি করে বসবাস করেছেন। এই দখল প্রক্রিয়া এখনো বহাল রয়েছে। এভাবে অন্তত দুইশ খাল নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।
এ ছাড়া ভরাট খালকে সরকারি তহশিলদারদের অনীহার কারণে এক শ্রেণির দখলদার কৃষিজমি হিসেবে ব্যাবহার করছেন। তবে যেসব এলাকার জলকপাট সংলগ্ন খাল এখনও দৃশ্যমান রয়েছে তাও একের পর বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের জন্য পুকুর, ঘের করা হয়েছে। কলাপাড়া পৌর শহরের বাদুরতলী খালটি এর অন্যতম উদাহরণ। যেখানে প্রশস্ত খালটির দুই পাড়ে অসংখ্য বাড়িঘর তোলা হয়েছে, খালের পাড় ভরাট করা হয়েছে।
জলকপাট সংলগ্ন সংযুক্ত এই খালটি এখন মৃত প্রায়। খালের নিয়ন্ত্রণ দুই পাড়ের কৃষকসহ সাধারণ মানুষের হাতে থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে জেলা প্রশাসনের এসএ শাখা থেকে জলকপাট সংযুক্ত বড় বড় খালগুলোকে বন্ধ জলমহাল দেখিয়ে মাছ চাষের নাম করে লিজ দেওয়া হয়।
যদিও এ বছর এই লীজ প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষিসহ গৃহস্থালি কাজে পর্যন্ত। গবাদিপশু পালনেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাপক দূষণের কারণে অধিকাংশ খাল মরা নালায় পরিণত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে কলাপাড়া উপজেলায় সকল খালের ইউনিয়ন ভিত্তিক তালিকা তৈরি করা, এস এ নকশা অনুসারে সকল খালের সীমানা চিহ্নিত করা, খালের দখল-দূষণ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, জলকপাট সংযুক্ত খালের নিয়ন্ত্রণ প্রকৃত কৃষকের হাতে ন্যাস্ত করা, খালকে কৃষিজমি দেখিয়ে দেওয়া সকল বন্দোবস্ত বাতিল করা, মাছ চাষের নামে কোনো খাল লিজ দেওয়া যাবে না এবং কৃষিকাজের ক্ষতি করে খালে লোনা পানির প্রবেশ বন্ধে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করার দাবি জানান।
এবিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউছার হামিদ খাল দখল-দূষণ নিয়ে বলেন,’কলাপাড়া পৌর শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত খালটির সীমানা চিহ্নিত করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ খালের পাড়ের অবৈধ দখলদারদেরকে উচ্ছেদ করা হবে। দখল, দূষণ হওয়া উপজেলার সকল খালের তালিকা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খালগুলো যাতে জনসাধারণ কৃষিকাজসহ সকল কাজে ব্যবহার করতে পারে আমরা সে ব্যবস্থাই নেব।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন




