পদ্মা ও কালনা সেতু চালু হলে পাল্টে যাবে নড়াইলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা
পদ্মা সেতুর পর কালনা সেতু চালু হলে পাল্টে যাবে নড়াইলের আর্থ সামাজিক অবস্থা।
এ দুটি সেতু চালু হলে নড়াইল হয়ে দেশের দক্ষিণের জেলাগুলোর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নবদিগন্তের সূচনা হবে। এতে নড়াইলে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। সম্ভাবনার দ্বার খুলবে মৎস্য, কৃষি, পর্যটনসহ অন্যান্য খাতে। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। পাল্টে যাবে নড়াইলের আর্থসামাজিক অবস্থা, এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২৫ জুন স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চালু হতে পারে কালনার দৃষ্টিনন্দন সেতু। এই সেতু দুটি চালু হলে নিজেদের উৎপাদিত নানা পণ্য সহজেই ঢাকায় বাজারজাত করতে পারবেন নড়াইলের চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ঢাকায় গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার দিনের দিনই বাড়িতে ফিরে আসতে পারবেন তারা। তাই এই সেতু দুটিকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত নড়াইলবাসী।
নড়াইল মৎস্য অফিস জানায়, জেলায় ৫ হাজার ৩৯১টি চিংড়ি ঘেরে ৩ হাজার ১৪৩ মেট্রিক টন চিংড়ি চাষ হয়। জেলার সাত হাজার ৩০৫ জন মৎস্যচাষি ১০ হাজার ৪২৫টি মৎস্য খামারে ৮ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন কার্প জাতীয় মাছের চাষ করেন। জেলার সাতটি নদী, ২৩৮টি খাল, বিল, প্লাবনভূমি, জলাশয় ও বরোপিট রয়েছে। এসব উৎস থেকে ৯ হাজার ৮৭৫ মেট্রিক টন দেশি প্রজাতির মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে। জেলায় কার্প জাতীয় মাছ, দেশি প্রজাতি এবং চিংড়ি মিলিয়ে ২১ হাজার ৮০৮ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদনের বিপরীতে মাছের চাহিদা রয়েছে ১৬ হাজার ৬৬০ টন। সরকারি হিসেবে নড়াইলে চিংড়ি ৩ হাজার ১৪৩ টন এবং কার্প জাতীয় মাছ ২ হাজার ৫ টন উদ্বৃত্ত থাকে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, খুলনা থেকে ইলিশ, বাগদা চিংড়ি, সামুদ্রিকসহ প্রায় ৩ হাজার টন মাছ নড়াইলের হাট-বাজারগুলোতে প্রবেশ করে।
চাষিরা জানান, নড়াইল থেকে ৮ হাজার টনের বেশি মাছ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। পদ্মা সেতু হয়ে এসব মাছ সরাসরি ঢাকায় বিক্রি করা গেলে তারা বেশ লাভবান হতে পারবেন।
কবির হোসেন নামে মাছ চাষি বলেন, আমরা দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ চালান করি। এখন পদ্মা সেতু চালু হলে আমরা সরাসরি ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে মাছ বিক্রি করতে পারবো। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে অল্প সময়ে ইলিশ মাছ নড়াইলে পৌঁছাবে। ফলে নড়াইলবাসীও কম মূল্যে এবং টাটকা ইলিশ খেতে পারবেন।
কৃষি বিভাগ জানায়, নড়াইল থেকে মৌসুমে প্রায় ১৩ কোটি টাকার শসা-ক্ষীরা দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। প্রতিদিন তিন ট্রাক (সপ্তাহে তিনদিন) পান ঢাকায় যায়, বছরে যার মূল্য ৬ কোটি টাকার বেশি। মৌসুমে দুই কোটি পিস আগাম জাতের দেশি লিচু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়, যার মূল্য ৩ কোটি টাকা। এছাড়া নড়াইল থেকে বছরে ৯ মাসে ৬০ ট্রাক ডাব দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। প্রতি ট্রাকে ২ হাজার অর্থাৎ ১ লাখ ২০ হাজার পিস ডাব যায়। এর আনুমানিক মূল্য ৬০ লাখ টাকা টাকা।
সদর উপজেলার বিছালী গ্রামের সবজি চাষি মো. মিঠু মোল্যা বলেন, মৌসুমের ছয় মাস নড়াইল থেকে প্রতিদিন প্রায় সাতশো মন শসা ও ক্ষীরা ঢাকায় যায়, যার আনুমানিক মূল্য সাত লাখ টাকা। পদ্মা সেতু চালু হলে অল্প সময়ে আমরা পণ্য ঢাকায় পাঠাতে পারবো। এতে টাটকা পণ্যের দামও বেশি পাব।
সদরের আউড়িয়া গ্রামের লিচু চাষি কামরুজ্জামান খান তুহিন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে নিজের বাগানের কমপক্ষে ১০ লাখ লিচু ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সরাসরি এনে বিক্রি করতে পারবো। ফলে দামও বেশি পাব।
খুলনা বিভাগের মধ্যে নদীবেষ্টিত এবং সবুজে ঘেরা নড়াইল একটি অন্যতম পর্যটন এলাকা। দৃষ্টিনন্দন পদ্মা সেতু এখন ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে।
নড়াইলের পরিবেশবিদ শরিফুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কম সময় এবং খরচে ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভ্রমণপিপাসুরা চিত্রা নদী তীরের চিত্রা রিসোর্ট, হাটবাড়িয়া ইকোপার্ক, মধুমতি নদী তীরের অরুনিমা ইকোপার্ক, নবগঙ্গা নদীর তীরের নিরিবিলি, স্বপ্নবিথি, চিত্রশিল্পী সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালাসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান উপভোগ করে দিনের দিন ঢাকায় ফিরে যেতে পারবেন। আবার অনেকে নাটক ও সিনেমার শুটিংয়ের জন্যও নড়াইলে আসতে পারেন।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, পদ্মা সেতু চালু হলে বছরে ১ লাখ পর্যটক নড়াইলে আসবেন। তাদের সব মিলিয়ে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা খরচ ধরলে বছরে পর্যটন খাত থেকে ২০ কোটি টাকা বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. হাসানুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে নড়াইল হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা। নড়াইলে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে তাদের জন্য অনেক উপকার হবে। এছাড়া নড়াইলের অনেক ব্যক্তি আছেন যারা ঢাকায় গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তারাও নড়াইলে ফিরে এসে ব্যবসা করার চিন্তা করছেন।
এরইমধ্যে বড় বড় কোম্পানি নড়াইলে এসে জমি কেনা শুরু করেছে। নড়াইলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি বিসিক শিল্প নগরী গড়ে তোলা। সেটা আজ বাস্তবায়ন হতে চলেছে। সেজন্য সাড়ে ৩০০ একর জমি বরাদ্দ হয়েছে। সেই ফাইলটা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কলকারখানা, ইন্ডাস্ট্রি হলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে, বেকারত্ব দূর হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নড়াইলের উপ-পরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে এসব কৃষি পণ্যের একটি বড় অংশ সরাসরি ঢাকাসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলায় যাবে। ফলে এসব পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যবসার পরিধি বাড়বে। কৃষক, ব্যবসায়ীসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এতদিন পদ্মা নদী পাড়ি দিতে গিয়ে ৪-৫ ঘণ্টা অপেক্ষার কারণে মাছ নরম ও নষ্ট হয়ে যেত। ফলে মৎস্য চাষি ও ব্যবসায়ীরা দামও কম পেত। এখন সরাসরি পদ্মা সেতু দিয়ে মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকায় গিয়ে টাটকা মাছ বিক্রি করতে পারবেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মারুফ হাসান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে নড়াইলের খামারিরা অনেক উপকৃত হবেন। কম খরচে ষাঁড়, গরু, ছাগল, ভেড়া ঢাকায় নিতে পারবেন এবং অনেক ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন। এবছর কোরবানির জন্য ১৯ হাজার ষাঁড় ও গরু এবং ৩০ হাজার খাসি, ছাগল, ভেড়া প্রস্তুত হয়েছে। এর মধ্যে সাত হাজার ষাঁড় ও গরু।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন