পবিত্র আশুরা শরীফ-১০ই মুহররমের আমল

পবিত্র আশুরার নামকরণঃ আশুরা শব্দ মুবারক আশারাহ শব্দ থেকে নিঃসৃত। যার অর্থ দশ। আশুরা মিনাল মুহররম হলো মুহররমুল হারাম শরীফ মাস উনার দশ তারিখ। পবিত্র মুহররম মাসের উল্লেখযোগ্য ও শ্রেষ্ঠতম দিন হচ্ছে ১০ই মুহররম ‘আশুরা’র দিনটি। এ দিনটি বিশ্বব্যাপী এক আলোচিত দিন। সৃষ্টির সূচনা হয় এ দিনে এবং সৃষ্টির সমাপ্তিও ঘটবে এ দিনে। বিশেষ বিশেষ সৃষ্টি এ দিনেই করা হয় এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনাও এ দিনেই সংঘটিত হয়। বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে শুরু করে সাইয়্যিদুনা আবুল বাশার হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পর্যন্ত প্রায় সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের কোন না কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা এ দিনে সংঘটিত হয়েছে। সঙ্গতকারণে এ দিনটি আমাদের সবার জন্যে এক মহান আনুষ্ঠানিকতার দিন, যা রহমত, বরকত, সাকীনা, মাগফিরাত, নিয়ামত মুবারক হাছিল করার দিন।এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-তোমরা মুহররম মাসকে এবং এর মধ্যস্থিত আশূরার দিনকে সম্মান করো। যে ব্যক্তি মুহররম মাস উনার আশূরার দিনকে সম্মান করবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে জান্নাত দ্বারা সম্মানিত করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন।”সুবহানাল্লাহ! (আল বাইয়্যিনাত শরীফ, ২৩৮তম সংখ্যা)পবিত্র আশূরা শরীফ উনার আমলসমূহ:১। পবিত্র আশুরা শরীফ উপলক্ষে দু’দিন রোযা রাখা:-
পবিত্র আশূরা শরীফ উপলক্ষে দু’দিন রোযা রাখা সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “পবিত্র রমাদ্বান শরীফ উনার ফরয রোযার পর উত্তম রোযা হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনার মাস পবিত্র মুহররম উনার রোযা। ” (মুসলিম শরীফ)অর্থ : হযরত আবূ কাতাদাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা পালনে আমি মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে আশা করি যে, তিনি (উম্মতের) বিগত বছরের গুনাহখতা ক্ষমা করে দিবেন। ” (মুসলিম শরীফ)অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “তোমরা ৯ ও ১০ই মুহররম রোযা রেখে ইহুদীদের খিলাফ তথা বিপরীত আমল করো। ” (তিরমিযী শরীফ)রোযা রাখার নিয়মঃ-
৯ ও ১০ তারিখ রোযা রাখা খাছ সুন্নত, ওযর (কারণ) থাকলে ১০ ও ১১ তারিখ। ইহুদীরা আশূরা উপলক্ষে ১ দিন রোযা রাখতো, ইহুদীদের খেলাফ করে ২ দিন রাখতে হবে। অর্থাৎ আশূরার ফযীলত পেতে হলে সমস্ত কিছু সুন্নত অনুসারে করতে হবে। কাফির মুশরিকদের অনুসরণ করা যাবেনা।২। রোযাদারদেরকে ইফতার করানোঃরোযাদারদেরকে ইফতার করানো সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-অর্থ : পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, তিনি যেন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সমস্ত উম্মতকে ইফতার করালো। সুবহানাল্লাহ!৩। পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন পরিবারবর্গকে ভালো খাওয়ানো :–পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন পরিবারবর্গকে ভালো খাওয়ানো সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যে ব্যক্তি আশূরা শরীফ উনার দিন তার পরিবারবর্গকে ভালো খাওয়াবে-পরাবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি সারা বৎসর ওই ব্যক্তিকে সচ্ছলতা দান করবেন। সুবহানাল্লাহ! (তবারানী শরীফ, শুয়াবুল ঈমান, মা ছাবাতা বিস্সুন্নাহ, মুমিন কে মাহে ওয়া সাল ইত্যাদি)
ভালো খাওয়া-পরার নিয়মঃ-
যেহেতু ৯ তারিখ ও ১০ তারিখ দিনে রোযা রাখতে হবে, তাই ৯ তারিখ দিবাগত রাতে ও সাহরীতে ভালো খাদ্য খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্যের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে পবিত্র সুন্নতী খাদ্য। এছাড়া খাবারের সুন্নতসমূহ পালন করতে হবে। যেমন- দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়া (খয়রি রঙয়ের খাসীর চামড়ার দস্তরখানা খাছ সুন্নত), নামায উনার ছূরতে বসে ‘বিসমিল্লাহি ওয়া ‘আলা বারাকাতিল্লাহ’ বলে খাওয়া শুরু করা, লবণ দিয়ে খাওয়া শুরু করা, প্লেটের ডান দিকের নিকট অংশ থেকে খাওয়া, মাঝখান থেকে খাবার না নেওয়া, দস্তরখানায় খাবার পড়লে তুলে খাওয়া সুন্নত, খাবার শেষে প্লেট ও আঙ্গুল চেটে খাওয়া ও লবণ দিয়ে খাওয়া শেষ করা। তিন শ্বাসে পানি পান করা। পেটের ৩ ভাগের ১ ভাগ খাবার, ১ ভাগ পানীয় ও ১ ভাগ খালি রাখা। আরো খাওয়া যেত এ অবস্থায় আহার ত্যাগ করা। খাওয়া শেষ করে এই দোয়া পড়া- ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী আতআমানা ওয়াছাক্বানা ওয়া জাআলানা মিনাল মুসলিমীন।’ কাঠের প্লেট-বাটি ও খাসীর চামড়ার দস্তরখানা ব্যবহার করা খাছ সুন্নত। এছাড়া উত্তম পোশাক পরিধান বলতে অবশ্যই সুন্নতী পোশাক পরতে হবে। ৪ ও ৫। গরিবদের পানাহার করানো ও ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানোঃ-গরিবদের পানাহার করানো ও ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-অর্থ: পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন কোন মুসলমান যদি কোন ইয়াতীমের মাথায় হাত স্পর্শ করে, কোন ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়ায় এবং কোন পিপাসার্তকে পানি পান করায় তাহলে মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে জান্নাত উনার দস্তরখানায় খাদ্য খাওয়াবেন এবং ‘সালসাবীল’ ঝর্ণা থেকে পানীয় (শরবত) পান করাবেন। সুবহানাল্লাহ!আশুরার অন্যান্য আমলের তুলনায় ৪ ও ৫নং আমল করা কঠিন। কেননা বদ আক্বীদা ও ফাসিক ফুজ্জার গরীব-মিসকিনকে খাওয়ালে বা সাহায্য সহযোগীতা করলে আশূরার ফযীলত লাভ হবে না। পক্ষান্তরে সঠিক আক্বীদা পোষণকারী নেককার গরীব-ইয়াতীম পাওয়া দুষ্কর। ৬। চোখে (ইছমিদ) সুরমা দেয়া :-চোখে সুরমা দেয়া সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-অর্থ : যে ব্যক্তি পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন মিশক মিশ্রিত সুরমা চোখে দিবে, সেদিন হতে পরবর্তী এক বৎসর তার চোখে কোন প্রকার রোগ হবেনা। সুবহানাল্লাহ! (মাক্বাছিদে হাসানাহ, শুয়াবুল ঈমান, দায়লামী,মাছাবাতা বিস সুন্নাহ)
সুরমা ব্যবহারের নিয়মঃ-
ইসমিদ সুরমা চোখে তিনটি নিয়মে দেয়া যায়। প্রথম নিয়মটি হলো- প্রথমে ডান চোখে দুইবার, তারপর বাম চোখে দুইবার। তারপর ডান চোখে একবার, বাম চোখে একবার। দ্বিতীয় নিয়মটি হলো- প্রথমে ডান চোখে তিনবার, তারপর বাম চোখে দুইবার। আর তৃতীয় নিয়মটি হলো- প্রথমে ডান চোখে তিনবার, তারপর বাম চোখে তিনবার। এভাবে যে কোন একটি নিয়মে আশূরার দিন ইসমিদ সুরমা ব্যবহার করতে হয়।৭। গোসল করাঃ-
পবিত্র আশুরা শরীফ উনার দিনে গোসল করা সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-অর্থ : যে ব্যক্তি পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন গোসল করবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে রোগ থেকে মুক্তি দান করবেন। মৃত্যু ব্যতীত তার কোন কঠিন রোগ হবেনা এবং সে অলসতা ও দুঃখ-কষ্ট হতে নিরাপদ থাকবে। সুবহানাল্লাহ!গোসল করার নিয়ম:–গোসল করার পূর্বে শরীরে যয়তুনের তেল দেয়া সুন্নত। মাথায় তেল দেয়ার নিয়ম হলো- প্রথমে ডান ভ্রুতে তারপর বাম ভ্রুতে, তারপর ডান চোখের পাতায়, তারপর বাম চোখের পাতায়। অতপর মাথার ডানদিক হতে প্রয়োজনমতো তেল দেয়া। আর দাড়িতে তেল দেয়ার নিয়ম হলো- প্রথমে ডান ভ্রুতে তারপর বাম ভ্রুতে, তারপর নিম দাড়িতে। অতপর দাড়ির ডান দিক হতে তেল দিতে হবে। তেল দেয়ার সময় সর্বক্ষেত্রে ডান দিকের অংশ আগে শুরু করতে হবে।তেল লাগানো শেষ হলে মিসওয়াক করে নিতে হবে। অতঃপর ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতে হবে এবং শুধুমাত্র পা ধোয়া ছাড়া নামাযের ওযূর মতো ভালভাবে ওযূ করে নিতে হবে। ওযূ কালীন রোযাদারের ভিতরে যাতে পানি প্রবেশ না করে, সেজন্য রোযাদার যেন গড়গড়ার সাথে কুলি না করে ও নাকে পানি দেয়ার সময় সতর্কতা বজায় রাখতে নাক নিচের দিকে নামিয়ে রাখতে হবে। ওযূ করা শেষ হলে প্রথমে মাথায় পানি ঢেলে চুলের গোড়া ভালভাবে আঙ্গুল দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে। পুরুষের বাবরী চুল থাকলে ও মহিলাদের বেনীবা খোঁপা থাকলে চুলের গোড়া ভালভাবে পানি পৌঁছাতে হবে।
অতঃপর ডান কাঁধে, অতঃপর বাম কাঁধে তিনবার করে এমনভাবে পানি ঢালা, যেনো সমস্ত শরীরে পানি বয়ে যায়। নাভি, বগল ও অন্যান্য কুঁচকানো জায়গায় পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুতে হবে। হাতে আংটি থাকলে সেখানেও পানি পৌঁছাতে হবে। প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করার সময় ধুন্দলের ছোবড়া ব্যবহার করা সুন্নত। আর পা ঘষার সময় ঝামা পাথর ব্যবহার করা সুন্নত। এক মুদ্দ (৬২৫ গ্রাম) পানি দিয়ে ওযূ এবং অনধিক পাঁচ মুদ্দ (৩১২৫ গ্রাম) বা প্রায় সোয়া তিন কেজি পানি দিয়ে গোসল শেষ করা সুন্নত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অপচয় করা ঠিক নয়। সমস্ত শরীরে পানি ঢালা শেষ হয়ে গেলে গোসলের জায়গা থেকে একটু সরে গিয়ে দুই পা ৩ বার ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে এবং সারা গা মুছতে হবে। মাথায় তেল দেয়া সুন্নত। মাথায় তেল দেয়ার নিয়ম হলো- আগে দুই ভ্রুতে তেল লাগাতে হয়, অতঃপর দুই চোখের পাতায় তেল দিয়ে মাথায় তেল দিতে হয়। অতএব, পবিত্র মুহররমুল হারাম মাস এবং উনার মধ্যস্থিত পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিনের ফাযায়িল-ফযীলত ও আমল সম্পর্কে জেনে সে মুতাবিক আমল করে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টি মুবারক হাছিল করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর দায়িত্ব-কর্তব্য।
মহান আল্লাহ পাক তিনি যেন আমাদের যামানার ইমাম ও মুযতাহিদ রাজারবাগ শরীফের হযরত মুজাদ্দিদে আযম সুলতানুন নাছীর মুরশিদ কিবলা আলাইহিস সালাম উনার উসিলায় নিয়ম অনুযায়ী আশুরা শরীফের আমল করে ফজিলত হাসিল করার তাওফিক দান করেন। আমীন!