পরীক্ষার দিন নয়, অনেক আগেই ফাঁস হয় প্রশ্ন
মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কৌশল নিলেও তা কাজে আসেনি। পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, এমন ধারণা থেকে পরীক্ষার্থীদের ৩০ মিনিট আগে হলে ঢোকানো হয়েছে। তবু প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যায়নি। এর কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, পরীক্ষার দিন বা আগের রাতে নয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে অনেক আগেই।
তাদের বক্তব্য, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ৪০ থেকে ৬০ জন প্রশ্নপত্র দেখার সুযোগ পায়। সেখান থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? প্রাথমিক সমাপনী থেকে পিএসসির প্রশ্নপত্র ও অন্য নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। আর তা ঠেকানোও যাচ্ছে না। অনেক আগে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও ছাপার মধ্যেই রয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের রহস্য। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘প্রশ্নপত্র অনেক আগেই ফাঁস হয়। আগে তা ছড়িয়ে দিলে ওই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হবে না বুঝেই পরীক্ষার দিন বা আগের দিন প্রযুক্তির মাধ্যমে তা ছাড়া হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সিন্ডিকেট প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটচ্ছে। তাদের না ধরে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি চাপিয়ে সিন্ডিকেটকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারি আকার ধারণ করেছে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘শিক্ষাবিদদের প্রযুক্তিগত বিষয়ের পরামর্শ নিচ্ছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাই সমাধান হচ্ছে না।’ এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন শিক্ষাবিদরা। দ্বিতীয় দিনের ফাঁসের ঘটনাকে মহামারি বলে উল্লেখ করেন তারা। বিব্রত শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা এ অবস্থার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাকে দায়ী করেন।
অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন,‘পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, অনেক আগেই প্রশ্নপত্র তাদের (ফাঁসকারী) হাতে থাকে। আগে তারা বলে না, বললে প্রশ্নপত্র অন্য আরেকটা তৈরি করা হবে তাই। প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগে ছাড়া হয় কর্তৃপক্ষকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে নিজেদের লাভবান করতে।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে আমি বিব্রত। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় না? মেডিক্যালের প্রশ্নপত্র, পিএসপির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় এবং নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়। এটা খুবই হতাশার। এটা রোধ করা অবশ্যই সম্ভব। পৃথিবীর অন্য দেশ পারে, আমরা কেন পারবো না? বুঝতে পারি, অন্য দেশের তুলনায় আমাদের বোধ নিম্নগামী। তাই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করা বন্ধ করতে হবে।’ যদি শেষ মুহূর্তে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয় তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন তিনি।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব উল্লেখ করে অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, ‘পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিলে ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আমাদের শিক্ষানীতি প্রণয়নের শেষ সময় ড. জাফর ইকবাল সে কথা বলেছেন।’ তিনি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র এত আগে ছাপানোই ফাঁসের রহস্য। কী করে নিশ্চিত হতে পারি, প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না? যে কেরানি, মেসেঞ্জার টাকার অভাবে একটা প্রশ্ন বাইরে দিলে ১০ হাজার টাকা পাবে, সে তো মনে করবে এটা বড় অপরাধ নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা যারা মারছে, তাদের অপরাধ হচ্ছে না। এটা কেন অপরাধ হবে?’
পরীক্ষার অনেক আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের হলে ঢুকিয়ে লাভ হলো না। দ্রুত পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দাদের মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক। ওই কমিটিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে সব ধরনের স্বাধীনতা দিতে হবে। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, সবার সামনে তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। তা যদি না করা হয়, তাহলে এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের লোকজনও জড়িত।’
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর সুপারিশ হিসেবে তিনি বলেন,প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে প্রয়োজন পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনবল পরিবর্তন, পাবলিক পরীক্ষা কমিয়ে দেওয়া এবং এমসিকিউ বাদ দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেওয়া। তা না করে সিন্ডিকেট শক্তিশালী করা হচ্ছে আর এ কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ ব্যর্থ। প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য যারা অতীতে দায়ী ছিল তাদের শাস্তি হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনে ঢালাও পরিবর্তন আনা দরকার।’
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘সময় নষ্ট না করে প্রযুক্তিবিদ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎস চিহ্নিত করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে অপরাধীকে। আর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক মূল্যায়নেও ব্যবস্থা নিতে হবে। পাবলিক পরীক্ষা কমাতে হবে।’ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন