পানি কিনে বিনা পয়সায় খাওয়ান চাওয়ালা

যে দেশের মাটিতে কয়েক কোদাল মারলেই পানি পাওয়া যায়, সেই দেশে কেন পানি কিনে খেতে হবে? এই প্রশ্নটি হয়তো এখন ঢাকা শহরের অনেকেরই মাথায় আসে না। কারণ পানি কিনে খেতে তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

আর্সেনিকসহ বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর ভয় দেখিয়ে পানিকে পুরোদস্তুর কেনা-বেচার পণ্য বানিয়ে ফেলেছে ব্যবসায়ীগোষ্ঠী। সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুর কথা, দেশে বোতলজাত পানি দিয়ে আরম্ভ হয় পানির ব্যবসা। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বোতলে ভরা পানি মূলত বিত্তশালীদের বাজার ধরার জন্য চালু হয়। সে সময় বড় ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে খাবারের সঙ্গে বোতলজাত পানি দেওয়া হতো। আর সেই বোতলজাত পানির বাজার সিকি শতাব্দী না পেরোতেই বেড়েছে বহুগুণে।

১৯৯০ সালে অ্যাকোয়া মিনারেল নামে দেশে প্রথম বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি নিয়ে আসে ‘সিঙ্গহা বাংলাদেশ’। ১৯৯১ সালে বাজারে আসে ‘এভারেস্ট ড্রিংকিং ওয়াটার’ নামের আরেকটি বোতলজাত পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।

‘মাম’ পানি বাজারে আসে ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালের প্রথম দিকে আসে ফ্রেশ, প্রাণ ও জীবন। এদের সঙ্গে ছিল বিদেশি প্রতিষ্ঠান ডানকান। ২০০৭ সালে বোতলজাত পানির ব্যবসা শুরু করে ঢাকা ওয়াসা। ১৯৯৫ সালে প্লাস্টিকের জারে পানির ব্যবসা শুরু করে আলপাইন ফ্রেশ ওয়াটার সিস্টেম লিমিটেড।

সাত বছর আগে একটি লেখায় সিনিয়র সহকর্মী টিটু দত্ত গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘আশির দশকেও ঢাকার রাস্তার মোড়ে, পার্কে, গাড়িতে বা স্টেশনে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের দেখা যেত পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে ঘুরতে। চাইলেই দৌড়ে এসে গ্লাসে ঢেলে পানি দিত, কত দিতে হবে জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘খুশি হয়ে যা দেন। ’

কারণ পানি বিক্রি হয় না, চাইলে দিতে হয়—এটা প্রচলিত সংস্কার। দরিদ্র শিশুটিও তা মেনে চলত। এখন রিকশা শ্রমিকও বোঝেন, পানি একটি পণ্য। ফুটপাতের দোকানের জার থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে তাঁকেও এক টাকা দিতে হয়। ’

পানির এই বাণিজ্যিকীকরণের মধ্যেও ব্যতিক্রম একজনকে খুঁজে পাওয়া গেল রাজধানীর মতিঝিলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর পাশের গেটের উল্টো দিকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নির্মাণাধীন ভবনের বাউন্ডারি ঘেঁষে ‘জয় টি স্টল’ নামে একটি চায়ের দোকান চালান বাবুল চন্দ্র ঘোষ। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। বাবুল নিজেও জানেন, ফুটপাতের ওপর বসে ব্যবসা করা বৈধ নয়।

তবুও পেটের দায়ে তিনি এই চা-বিস্কুট বিক্রির কাজ করছেন প্রায় ৪০ বছর ধরে। প্রথম দিকে কল কিংবা পাম্পের পানি খাওয়াতেন ক্রেতাদের। পরে প্লাস্টিকের জারে পানি বিক্রি শুরু হলে দোকানে বিশুদ্ধ পানি রাখা শুরু করেন। কিন্তু কখনোই পানি বিক্রি করেননি। ১৭ বছর ধরে নিজের পয়সায় জার কিনে বিশুদ্ধ পানি খাওয়াচ্ছেন ক্রেতা ও পথচারীদের।

বাবুল বলেন, ‘ভাই, পানি বেচি না। এক কাপ চা বিক্রি করলে ২ টাকা লাভ (মুনাফা) হয়। এক গ্লাস পানির দাম পড়ে ২০ পয়সা। যে কয় গ্লাস মন চায় খান। পয়সা দিতে হবে না। ’ অন্য চা বিক্রেতারাও মুনাফা করে, কিন্তু তারা তো পানির দাম রাখে। আপনি কেন রাখেন না?’ বাবুল বলেন, ‘মানবসেবা। শুরু থেকেই আমি পানি বেচি না।

যারা বেচে তারা বেচে। আমার দোকানে চা-বিস্কুট না খেয়ে কেবল পানি খাইলেও টাকা দিতে হবে না। অনেকে আছে, বাসে কইরা গ্রামে যাবে, আমার এইহান থাইকা বোতল ভইরা পানি নিয়ে যায়। গায়ে হাত বুলাইয়া কয়, আল্লাহ আপনার ভালো করব। ’

এমন কোনো ঘটনা আছে, যে কারণে আপনি পানি বিক্রি করেন না? ‘অনেক আগে একবার আমার ছেলেটারে নিয়া এক চা দোকানে গেছিলাম, পানির পিপাসা লাগছিল। কিন্তু দোকানদারের ব্যবহার আমার ভালো লাগে নাই।

আমিও চা বেচি। আমি কোনো দিন পানি বিক্রি করব না সেই দিন সিদ্ধান্ত নিছি। ’ বলেন বাবুল। ঢাকার মতিঝিলে বাবুলের বাবার মিষ্টির ব্যবসা ছিল। পৈতৃক পেশায় না গিয়ে চা বিক্রি শুরু করেন বাবুল। এ দিয়েই সংসার চলে তাঁর। বাবুলের দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেটি নবম শ্রেণিতে পড়ে। ক্রিকেট খেলতে বেশ পছন্দ করে ছেলেটি। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর।

প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি জার কেনেন বাবুল। এর জন্য তাঁর খরচ হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। বাবুল বলেন, ‘অনেক কম্পানির জার পাওয়া যায়। আমি ভালো একটি কম্পানির পানি কিনি। জারের গায়ে নাম লেখা আছে। ফোন নম্বরও আছে।

খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। ’ আশপাশের চায়ের দোকানগুলোর তুলনায় বাবুলের দোকানে ব্যবহূত পানির জারগুলো আসলেই বেশ নতুন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আল-হেরা এন্টারপ্রাইজের জেডএএন ড্রিংকিং ওয়াটারের জার নিচ্ছেন বাবুল।

বর্তমান বাজারে এমন পয়সা দিয়ে পানি কিনে বিনা পয়সায় খাওয়ানোর মতো মহৎ উদ্যোগ আর দেখা যায় না। বাবুল জানান, আরো দুইজন চা বিক্রেতা আছেন, যাঁরা পানি বিক্রি করেন না। তবে তাঁরা ঢাকার নন, চট্টগ্রামের। এটাও তিনি শুনেছেন। কিন্তু ওই দুই চা বিক্রেতাকে দেখেননি কখনো।