পাহাড়ের পাদদেশে ‘নতুন সংসার’ গোছাচ্ছেন রোহিঙ্গা নারীরা

উখিয়ার থাইংখালির অস্থায়ী ক্যাম্পে ন্যাড়া পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকটি বাঁশ আর পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ঘর বেঁধেছেন ফিরোজা খাতুন। এর ভেতরে গুছিয়ে নিচ্ছেন সংসার। সপ্তাহখানেক আগে মিয়ানমারের মংডুর নাইয়ারবিল এলাকা থেকে যখন এখানে আসেন, তখন পথের ধারে এক অনিশ্চিতের দিকে চেয়ে থাকতেন। এখন বৃষ্টিতে ভিজে ঝুপড়ির ভেতরের মাটি স্যাঁতসেতে হলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে। দূর হয়েছে খাবারের ভাবনা।

তাই ফিরোজার মতো রোহিঙ্গা নারীরা ক্লান্তি ঝেড়ে আবার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শামিল করেছেন নিজেদের। ত্রিপল কিংবা পলিথিনের ঝুপড়িতে গুছিযে নিচ্ছেন ‘নতুন সংসার’।

মিয়ানমারের সেনা ও স্থানীয় মগদের নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গা নারীরা পালিয়ে আসার সময় সেখানে ফেলে এসেছেন তাদের ‘সোনার সংসার’। চাষের জমি। স্বজন-প্রতিবেশী, যাদের অনেককে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছেন। প্রাণ বাঁচাতে ফেলে এসেছেন স্বজনের মৃতদেহ। ছুটতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে সন্তান। এসব দুঃসহ যন্ত্রণা আর দীর্ঘ বন্ধুর পথের কষ্ট পেছনে ফেলে নতুন আশ্রয়ে নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারীরা। বনভূমির আট হাত বাই দশ হাত পলিথিনের ছাউনিতে সংসার গোছাতে গোছাতে তারা আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন।

উখিয়ার থাইংখালির অস্থায়ী ক্যাম্পে ন্যাড়া পাহাড়ের পাদদেশে সংসার পেতেছেন যে ফিরোজা খাতুন, ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকজনের কাছ থেকে পেয়েচেন ত্রাণ ও কিছু টাকা। পলিথিনের আড়াআড়ি ঝুপড়িঘরেই কিনে নিয়ে এসেছেন গ্যাসের চুলা। বৃহস্পতিবার পেয়েছেন বিশ্বখাদ্য সংস্থার দেয়া রেশন কার্ড। আট ছেলেমেয়ে নিয়ে তার পরিবারের জন্য এ মাসে পেয়েছেন ৬০ কেজি চাল। এখন রান্নাবাড়া করতে তার আর কোনো অসুবিধা নেই। তার চোখেমুখে হতাশা আছে ঠিক, তবে দিশেহারা ভাব নেই।

ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নিজেদের বসতবাড়ি ছাড়া কিছু চাষের জমিও ছিল ফিরোজার। বিত্ত না থাকলেও অভাব ছিল না তাদের। ছিল সাজানো-গোছানো সংসার। ছয় ছেলের মধ্যে বড় ছেলে জামাল ও মেঝ ছেলে সেলিম দশম শ্রেণিতে পড়ত। সেজ ছেলে হাফেজ ছিল পাড়ার মসজিদের ইমাম। অন্য তিন ছেলের মধ্যে ইয়াসির অষ্টম, আরাফাত ষষ্ঠ ও ছোট ছেলে মনসুর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত।

চোখের সামনে তার সাজানো সংসার ছাই হতে দেখেছেন ফিরোজা। অনেক স্বজন ও প্রতিবেশীকে হারিয়েছেন এক মাসের মধ্যে। এখনো চোখ বুজলে সেসব দুঃসহ ছবি ভেসে ওঠে। ছেলেদের মুখ দেখে সেসব ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন তিনি। সামনের দিনগুলোয় তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর সন্তানদের লেখাপড়া কথাও নাড়া দিয়ে যায় মনে।

পুলিশ ফাঁড়িতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার অভিযোগে গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস অভিযান চালায় সে দেশের সেনাবাহিনী। তারা হত্যা, বাড়িঘরে আগুন, নারীদের নির‌্যাতন করতে থাকলে সব ছেড়ে পালায় রোহিঙ্গারা। দলে দলে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। তাদের ৬০ শতাংশ শিশু। হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষকে হত্যা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা প্রথমে রাস্তার পাশে, পাহাড়ে গ্রামীদের বাগানে, বাড়ির আঙিনায়, জমির উঁচু জায়গায় পলিথিনের ছাউনি টানিয়ে দিন কাটিয়েছে। একটু ত্রাণের জন্য ট্রাকের পেছন পেছন ছুটেছে। সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয়ার পর এখন খাবারের জন্য রাস্তায় সারা দিন কাটাতে হয় না তাদের। ব্যক্তিপর্যায়ের সাহায্যকারী লোকজন ঘরে গিয়ে দিয়ে আসছেন নগদ টাকা কিংবা অন্যান্য সাহায্য। আর তাতে রোহিঙ্গা নারীরা মনোযোগ দিচ্ছেন সংসার গোছানোয়।