পিছু ছাড়ছে না আগুন, মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে লাফ
অগ্নিকাণ্ড পিছু ছাড়ছে না রাজধানী ঢাকাবাসীর। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
বনানীর অগ্নিকাণ্ডে ২৫ নিহত ও ৭০ জন আহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। এদের কারো মৃত্যু হয়েছে পুড়ে, ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে এবং কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বাঁচার চেষ্টায় লাফিয়ে পড়ে।
তবে হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ডিডি) দিলীপ কুমার ঘোষ প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে উদ্ধারকাজ চলছে। ভবনে কেউ জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় আটকা পড়ে আছে কি না তা অনুসন্ধানে কাজ করছে উদ্ধারকারী দল। চার ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে নিহতদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আবদুল আহাদ। তার দেওয়া তথ্যমতে, নিহতরা হলেন পারভেজ সাজ্জাদ (৪৭), মামুন (৩৬), আমিনা ইয়াসমিন (৪০), আবদুল্লাহ আল ফারুক (৩২), মনির (৫০), মাকসুদুর (৩৬) এবং শ্রীলঙ্কার নাগরিক নিরশ ভিগ্নে রাজা (৪০)। নিরস ওই ভবনের স্কেন ওয়েল লজিস্টিকসের ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন।
পারভেজ সাজ্জাদ গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির বালু গ্রামের নজরুল ইসলাম মৃধার ছেলে। মামুনের মৃত্যু হয়েছে ইউনাইটেড হাসপাতালে। তিনি এফআর টাওয়ারে অবস্থিত রিজেন্ট এয়ারের কর্মকর্তা ছিলেন। দিনাজপুর সদরের বালিয়াকান্দির আবুল কাশেমের ছেলে তিনি। মনির ও মাকসুদুরেরও মৃত্যু হয়েছে ইউনাইটেড হাসপাতালে। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার আলভগঞ্জ রোডের মিজানুর রহমানের ছেলে মাকসুদুর। মনিরের পরিচয় জানা যায়নি। এছাড়া কুর্মিটোলা হাসপাতালে মারা যান নিরস ভিগ্নে রাজা। অ্যাপোলো হাসপাতালে মারা যান আমিনা ইয়াসমিন। ঢাকা মেডিকেলে মারা যান আবদুল্লাহ আল ফারুক। তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ২২তলা ওই বাণিজ্যিক ভবনের সবগুলো তলাতেই দোকান ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস। সপ্তাহের শেষ দিন দুপুরের খাবারের বিরতির আগে আগে সব অফিসেই তখন ছিল ভীষণ ব্যস্ততা।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন জানান, বেলা ১২টা ৫২ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে তাদের ১৩টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করে। পরে আরো ১২টি ইউনিট তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এছাড়া সেনা, নৌ, বিমান, র্যাব, ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজে অংশ নেন। পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্টসহ অনেক স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেছেন। সামরিক বাহিনীর ৫টি হেলিকপ্টার উদ্ধারকাজে অংশ নেয় বলে জানান আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল ইসলাম খান।
বেলা ৩টার দিকে আগুনের তীব্রতা কমে আসার পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা মই লাগিয়ে ওপরের ফ্লোরগুলোতে আটকেপড়াদের নামিয়ে আনতে শুরু করেন। তখনো অষ্টম তলায় দেখা যাচ্ছিল আগুনের শিখা।
আগুনে ২২ তলা ভবনের সপ্তম, অষ্টম ও নবম তলা আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। নবম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। টানা চার ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তবে তখনো কয়েকটি ফ্লোর থেকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিল। ধোঁয়া বের হচ্ছিল ভবনের বিভিন্ন অংশ থেকে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এফআর টাওয়ারের আগুন ৯৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং) সিদ্দিক মো. জুলফিকার আহমেদ। সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলেই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ভেতরে টেম্পারেচার হাই হওয়ার কারণে কিছু জায়গায় আগুন জ্বলছে।
তবে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত তা জানাতে পারেননি কেউ। ফায়ার সার্ভিস পরিচালক বলেন, ‘৫-৭টি ফ্লোর আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯-১০ তলা থেকে শুরু করে ওপরের দিকের ফ্লোরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, কী কারণে আগুন লেগেছে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। তবে এটুকু বলতে পারি, এ ধরনের বিল্ডিংয়ে সাধারণত ইলেকট্রিসিটি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ভবন তৈরির সময় ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা হয়। যে কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি আরো বলেন, ২২ তলা এই বিল্ডিংয়ে ফায়ার ফাইটিংয়ের নিজস্ব কোনো ক্যাপাসিটি নেই। বিল্ডিংগুলোতে যতদিন পর্যন্ত আগুন নির্বাপণের নিজস্ব সক্ষমতা না থাকবে, ততদিন এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আর এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও বাড়তেই থাকবে।
সিদ্দিক মো. জুলফিকার আহমেদ বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা আগুন লাগার কারণ এবং করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করব। এ ধরনের অবহেলা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। আর ছাড় দেওয়া যাবে না।
মানুষের ভিড়ে কাজে প্রতিবন্ধকতা : আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এফআর টাওয়ারের নিচে ভিড় জমাতে শুরু করেন উৎসুক জনতা। তাদের কেউ ছবি তোলেন, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। কেউ আবার আসেন লাইভে। তাদের কারণে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীদের। ওই ভবনে আটকেপড়া মানুষের স্বজনরাও ভিড় জমান নিচে। জনতার ভিড়ে তারাও পড়েন বিপাকে।
কামাল আতাতুর্ক রোড থেকে গুলশানগামী সড়ক, মূল রাস্তাসহ পুরো রাস্তায় নামে মানুষের ঢল। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঁশি বাজিয়ে ও অনুরোধ করেও তাদের সরাতে পারেননি।
ঢাকা মেডিকেলে স্বজনদের ভিড় : ঘটনার পর ওই ভবনে নানা কাজে থাকা ব্যক্তিদের স্বজনরা ভিড় জমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এই হাসপাতালে আহত হয়ে আসেন একজন।
তিনি শ্রীলঙ্কার নাগরিক ইন্ডিকা মারসিলিন (৪৬)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, ইন্ডিকা মারসিলিনকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তিনি হাতে আঘাত পেয়েছেন। তবে আঘাত গুরুতর নয়। তিনি দোতলা থেকে লাফ দিতে গিয়ে আহত হন বলে চিকিৎসকদের জানান। এফআর টাওয়ারে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়েই মেডিকেলে আসেন অনেকে। এমন একজন তারিকুন্নাহার। তার ভাই আনজীর সিদ্দিক ভবনের ১৮ তলায় একটি অফিসের কর্মকর্তা।
তারিকুন্নাহারের স্বামী দেলোয়ার হোসেন বলেন, দুপুর ১টার দিকে আনজীরের সঙ্গে শেষবার কথা হয়। এরপর থেকে আনজীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
আগুন লাগার পর এফআর টাওয়ারের পাশের ভবনে থাকা দুরন্ত টেলিভিশন ও রেডিও টুডের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন