পিরিতির বাজারের পথে একদিন || নাজমীন মর্তুজা

সে বহুদিন আগের কথা, একটা গ্রামের হাটের পথের দৃশ্য স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো , তখনো আমি স্কুলের বেড়া টপকে কলেজে পৌঁছুইনি, দিব্বি গায়ে ফ্রক চাপিয়ে পায়ে মোগল হাওয়াইচপ্পল গোলিয়ে, বেশ বড় রাস্তার ধুলোর পাউডার উড়াতে উড়াতে একদিন সেই হাটের পথে রওনা হোলাম । মহা আনন্দে আব্বার হাত ধরে যাচ্ছি, বড় রাস্তায় এত ধুলো সাইকেল ভ্যান কিছুই যেন সহজ গতীতে যেতে পারছে না, একটু যেতে না যেতেই আব্বা বলে উঠছে ধুর বেটি ! এত ধুলা ভূত হয়ে গেলাম, আহা ধুলোর ভেতর পা ঢুকায় না মা, কে শোনে কার কথা, আমি যেন ধুলোর ঢিবির ভেতরে পা ঢুকিয়ে নরম একটা সুখ নিতে থাকলাম, ফ্রক, পা, মাথার চুল, চোখের পাপড়ির উপরে ধুলোরপুরু পরত, আমি বেশ আনন্দ করে পথ চলছি , কোন ক্লান্তি নেই, হাটের পথে যেতে যেতে কত কিছুই না দেখছি, একটু পর পর আব্বাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছি , আব্বা আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত, যেটা পারছে না সেটা কেবল বলছে, কি জানি মা জানি না তো ! আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে প্রায় দু মাইল চলে এসেছি, আব্বা কে জিজ্ঞেস করছি আর কত দূর ? আব্বা বলছে ঐ তো হাটের লোক জন হাটের পথ ধরছে রে মা, বেশী দূর না চলে এসেছি ।

আমরা যাচ্ছি নোটন জাতের কবুতর কিনতে, আমি কবুতর ( পায়রা) পুষবো , পিরিতির বাজারে পাওয়া যায় , আমাদের বোচাগন্জের বাজারে পাওয়া যায় তবে রেয়ার , কিন্তু গ্রামের হাট গুলোতে সহজেই পাওয়া যায় । অদ্ভুত একটা আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে মনে । একই হাটে কত কত মানুষ যাচ্ছে , কারো কাঁধে সাইনবোর্ড , সেখানে বড় বড় করে লেখা নানা ধরনের বিজ্ঞাপনের কথা , দাঁতের মাজন , একটা লোকের কাঁধে দেখলাম লম্বাচওডা় বড় নতুন লাল সালু কাপড়ে লেখা দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা নিন, মনে মনে ভাবলাম গিয়ে এক বোতল টিকটিকির ডিম নিয়ে খাবো , হোমিওপ্যাথির দানা , সে আমার ভীষণ পছন্দের খাবার । ডাক্তার বাবু যদি আট থেকে দশ টা দানা খেতে বলেন আমি বিশ টা খেয়ে নেই , সুযোগ পেলে তো কথাই নাই পুরো শিশি উপুড় করে ঢেলে দিতাম মুখে ।

একটা সরকারী সাইনবোর্ড ও চোখে পড়লো, ভ্যানে শুইয়ে নিয়ে যাচ্ছে, পরিবার পরিকল্পনা, ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তান-ই যথেষ্ট। ওটা দেখে আব্বা কে বল্লাম আব্বা আমাদের তো সুখি পরিবার তাই নাহ? আব্বা হেসে বললো হ্যাঁ রে মা । আমার ধারনা হয়েছিল সে সময় ঐ বিজ্ঞাপন টা দেখে , কারণ আমরা দু ভাই বোন, তাই নিশ্চিন্তে বলা যায় সুখি পরিবার । আরো কত কত কি সব ! একটা লোক সাইন বোর্ড টা টেনে একাঁধ তো আর একবার অন্য কাঁধে ঝুলিয়ে নিচ্ছে , আমার পড়তে কষ্ট হচ্ছে , কি লেখা তাতে , কষ্ট করে লোকটার চলার ছন্দের ফাঁক ফোকর দিয়ে পড়লাম, এখানে হারিয়ে যাওয়া পুরুষের শক্তি কে ফিরিয়ে দিতে আমরা বন্ধু হয়ে সন্জিবনী হয়ে পাশে আছি । ঠিক বুঝিনি ওটা কিসের বিজ্ঞাপণ। সাইনবোর্ড টা টানতে লোকটার বেশ কষ্ট হচ্ছে . একবার ডান হাতে তো একবার বা হাতে, একটু থেমে থেমে যাচ্ছে হাত বদল করতে করতে, ওকে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম । সামনে একটা লোক হাঁটছেন খুব দ্রুত নাইলনের জুতো পায়ে, মনে হয় কোথাও খালে – খন্দকে পা চুবিয়ে এসেছে, কি অদ্ভুত একটা শব্দ করে চলছে সে, আমি তাকিয়ে আছি ওর চলার পথে , মনে হচ্ছে সেন্ডেল থেকে এই বুঝি পা টা বাহিরে এসে পড়লো, নাহ সে দিব্বি একটা পুউৎ পুউৎ শব্দ তুলে ছন্দে ছন্দে হেঁটে যাচ্ছে, মাথায় বিশাল একটা সিলভারের পাতিল, সাইজটা বিশাল , মাথায় পেষ্টা ফিট করে কায়দা করে বসিয়ে রেখেছে , মাঝে মাঝে পানিতে মাছ ছেড়ে দিলে কেমন খলখলিয়ে উঠে, তেমন শব্দ পাচ্ছি, বুঝলাম তাজা মাছ বেচ তে যাচ্ছে সে। একটা খাটো মতো লোক পেছন থেকে হঠাৎ আমার পাশে এসে পড়ছে , কাঁধে সাদা দুটো কাপড়ের গোল পুটলি ঝুলিয়েছে , মনে হয় শাক পাতা বেঁধে নিয়েছে, আব্বা কে দেখে বললো আপনার মেয়ে নাকি দাদা, তো কি মা হাটে যাচ্ছো বুঝি ? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলি । লোকটার পুটলিতে হাত বুলিয়ে বললো এটার ভেতর হজরত মাই ( জ্বিন) বাড়িতে এরা খুব অত্যাচার করছে তো তাই হাটে বেচে দেবো আজ । আমি ভয় পেয়ে আব্বার হাত চেপে ধরি । লোকটা হেসে দেয় , বলে না না ভয় পায় না , এখানে শাক আছে পবা শাক , মাগুর মাছের ঝোলে পবা শাক , আমি তখনো সে শাকের স্বাদ কেমন জানি না । তখনো খাইনি , পরে অবশ্য সেই শাকের স্বাদ নেবার সৌভাগ্য হয়েছে , তেমন বিশেষ স্বাদ লাগেনি যদিও , বিশ্রী একটা গন্ধ । লোকটা থলি গুলো পিঠে ঝুলিয়ে বিড়ি খেতে খেতে মহানন্দে হেঁটে যাচ্ছে । বিড়িই যেন তাকে পথের রাজা বানিয়ে দিয়েছে । লুঙ্গীটা হাঁটুর উপড়ে – যেন কত নদী নালা , কাদা- বালী পেরিয়ে যাচ্ছে সে ।

পায়ে নতুন নীল রূপসা হাওয়াই সোলটা ঠিকঠাক মত আছে কিন্তু বুড়ো আঙুলের সামনেরটা ক্ষয় হয়ে গেছে , যদি সেন্ডেলটা খুলে তো বুড়ো আঙুল বরাবর একটা ফুটো সহজেই চোখে পরবে । চারপাশ নির্জন ধু ধু , শুধু এই রাস্তাটুকু দিয়ে লাইন বেঁধে হাটের লোক চলছে । শুক্রবার পিরিতির বাজার , চতুর দিকের মানুষ আসে , গ্রামের উঁচু নিঁচু রাস্তা ঠেলে ঠুলে রিক্সা পার করে , ভ্যান গাড়িতেও মাল তুলে দেয় । মহিষের গাড়ি গরুর গাড়ি তো আছেই । বড় বড় মালপত্র যাদের তাদেরও বাহন লাগে , কাটা কাপড় ,গেন্জি লুঙ্গী , শার্ট পেন্টের দোকানিরা সাইকেলের সামনে ঝুলিয়ে , পেছনে বেঁধে , কাজ সেরে নেয় । কিন্তু আলু , পটোল , পাট , ব্যবসায়ীদের জন্য রিক্সা ভ্যান গাড়ি লাগেই । মাথায় মাথায় আর কতই বয়ে নেয়া যায় । তবে ছোট খাটো ব্যসায়ীরা হেঁটেই চলে মাথা বা বাঁকে ঝুলিয়ে । বড় রাস্তা মানে হাই ওয়ে থেকে নেমে বাসের মাথা থেকে বোঝা মানিয়ে রিক্সা ভ্যানে করে মাল গ্রামের হাটে নিয়ে যাওয়া সুবিধা ।

আব্বা বললো ভালই হয়েছে ভাই পাশের পথিক কে এই ভ্যান গাড়ি চালু হয়ে । উনিও সায় দিয়ে বললে , খুউব ভালো হইছে ভাই , আমি মাঝখানে কথা গুঁজে দিয়ে জানতে চাইলাম আব্বা আর কত দুর , ঐ তো মা আর বেশী দূর নাই , হাটের মানুষের গম গমানী আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে , ইতি মধ্যে আমাদের কে পাশ কাটিয়ে অনেক লোক চলে গেছে অনেক টা সামনে । ডানে বাঁয়ে হায় হায় পাথার , সবুজ ময় সবুজ থেকে টাড়ি টাড়ি – জঙ্গলের ভেতর , ছোট ছোট খাল – খন্দ পেরিয়ে পেরিয়ে , বাঁকে বা মাথায় বোঝা নিয়ে , গরু ছাগল তাড়িয়ে তাড়িয়ে রাস্তা ছোট করতে করতে আসে । চিলতে রাস্তা টুকুতে যেন অদ্ভুত একটা বেগ অনুভব করি , কখনো পথ চলার নিরবতা ভেঙ্গে হুন্ডা ওয়ালা ভো ভো করতে করতে দুরে মিলিয়ে যায় , আমার নাকে প্রেট্রোল পোড়া গন্ধ লেগে থাকে ।

দু একটা ফোনিক্স সাইকেলের ঝুমঝুমি লাগানো আওয়াজ বহুদুর থেকে টের পাওয়া যায় , নতুন বিয়ে করা জামাই , শ্বশুড় বাড়ির উপহার পেয়ে মহা খুশি যে তা সে জানিয়ে দেয় প্যাডেলে দ্রুত চাপ দিয়ে ঝড়ের গতীতে পাশ কাটিয়ে যায় , পায়ে হাঁটা লোকদের , বুঝিয়ে দেয় আমি রাস্তার রাজা । আমরা খুব কাছে চলে এসেছি হাটের , এখন মানুষের হাঁটার গতী বেশ দ্রুত , তাদের জায়গা দখল করতে হবে বলে এত ব্যস্ততা । তাড়াতাড়ি হাঁটার বা মাল বইবার ফলে মানুষ জনের দ্রুত নিশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায় । চার পাশ এত নির্জন যে মানুষের শ্বাস নেয়া- ছাড়ার মত প্রায় নি: শ্বব্দ আওয়াজ ও মিশে যেতে পারে না , আলাদা হয়ে থাকে । কিন্তু হাটে যাবার শেষ বেলা বলেই হোক বা এই রাস্তাটুকু কাঁচা বলেই হোক মানুষ ছুটতে থাকলেও কেমন যেন জমাট মনে হয় । এতগুলো মানুষ এক সঙ্গে একই দিকে যাচ্ছে , এতেই যেন সবার মধ্যে একটা মিল পাওয়া যায় মনে হচ্ছে একই পথের পথিক । হাটে মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে দুর থেকে , ভিড়ও হচ্ছে একটা লোক একটি মাত্র ছাগল নতুন দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে । ছাগলটার মনে হয় ভয় করছে , এক পাও ফেলছে না , লোকটা সমানে টেনে যাচ্ছে যেন সে জানে এমনি করেই হাটে পৌঁছুতে হবে । ছাগলটা এতই ভয় পেয়েছে যে শেষ নখরা টুকুও দেখাতে দেরী করছে না , হুট হাট বসে পড়ছে রাস্তায় । লোকটা ছাগলটাকে টানছেও না সাধছেও না । ছাগলটার পেছনেই হাঁটছিল একটা মাঝবয়সি চা ওয়ালা , কাঠের চায়ের প্যাটির বাক্সো তার ভেতরেই কেরোসিনের চুলো , চা বানানোর কেটলী , ছাগলটা বসে গেলেই সে ঠিক পেছনেই আস্তে করে লাথি মারছিলো , আর ছাগল টা কয়েক পা দৌড় । আর ছাগলের মালিক একটা কন্চি নিয়ে একটু গুতা দিলেই সে উঠে হাঁটা দেয়া শুরু করে দেয় । চারটা মুরগী আর তিনটা হাঁস উল্টো করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা লুঙ্গী পরা লোক । মাঝখানে একটা ছোট ছেলের মাথায় চুনা চাল কুমড়ো , ছোট হাফপেন্ট পড়া সামনের জিপটা খোলা, মনে হয় ইচ্ছে করে খুলে রাখেনি , জিপের রানারটা নষ্ট তাই অগত্যা , পা খালি , বোচাগন্জের মানুষ খুব একটা এই হাটে যায় না , কারণ বোচাগন্জের হাটই তো নামকরা ।

একটা ঢাকাইয়া পোলা সাদা শার্ট গায়ে হাতা গোটানো , তেল কুচকুচে কোঁকড়ানো চুল , পাতালা শার্টের ভেতর দিয়ে কমলা নেটের গেন্জির দেখা যাচ্ছে বুকের দুটো বোতাম ইচ্ছে করে খুলে রেখেছে , কিছুটা নায়ক নায়ক ভাব , মনে হয় হাটে কারো সাথে দেখা করতে যাচ্ছে । মেজাজ টা তার মেলেটারী চলনে বলনে। একটা বুড়া লোক মাথায় ডালিতে করে ছ সাত টা কচি লাউ নিয়ে যাচ্ছে , লাউয়ের গায়ে সাদা সুঙ্গা এখনো ধারালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।একজনের মাথায় অনেক গুলো বাঁশের ডালি কুলো চালনি, কিছুদুর পরেই হাট আমরা হাটের বাঁকে এসে পৌছেছি , গায়ে চেক শার্ট সাদা লুঙ্গী , রবারের পাম্পসু , কাঁধে মাফলার , সারা শরীরের মাংসের আধিক্য পেটানো শরীর , মুখে পান, হাতে হরিণ বিড়ি , দেখে মনে হলো জোতদারের নাতি , একবার মনে হলো ব্যপারী হবে , পরে আব্বাকে সালাম বিনিময় করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম আব্বা লোকটা কে , আব্বা বললো ডাকাত .. ওর নাম বরজাহান , ভয়ে ছাতি শুকিয়ে যাওয়া অবস্থা আমার । সে সময়ে মেম্বার ছিলেন ।

একটা লোক হঠাৎ এসে আমার হাত চেপে ধরলো সে কি খিস্তি খেউর , কিছুটা বিরক্তি নিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি , লোক অদ্ভুত নাছোড় বান্দা , আব্বা হাসছে, বলছে তোর নানা হয় মা, ভাবছি এ কেমন নানা , কি পচা পচা ইয়ার্কি মারছে, শেষ মেষ হাত ছেড়ে দেয়াতে রক্ষা । হাটে ঢুকেই প্রথমে খেলাম গুড়া পিয়াজি, তারপর বাতাসা , তিলের খাজা, কিনলাম দুজোডা় কবুতোর, আমার পিরিতির বাজারে আসা সার্থক হলো। আমি আব্বার হাত ধরে বল্লাম আব্বা চল বাড়ির দিকে হাঁটা দেই , আব্বা পিঠার দোকানের চেরাগ বাতির সামনে নিয়ে আমাকে বললো দাঁড়াও মা আমি একশ সাঁচি পান নিয়ে আসি । আমি কলার গাছের খোলে মোডা়নো কবুতরের বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে থাকি , সেদিনের পথ শ্রম ভুলে গিয়েছি ঠিক, কিন্তু স্মৃতিতে একটা হাটের আয়োজন এখনো গেঁথে আছে . আহা শৈশব তোমাকে ভাঙিয়েই চলছি দিন যাপনের পথে পথে।