পিয়ন থেকে কোটিপতি মহিউদ্দিন!

কক্সবাজারের মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক ওরফে বার্মা রাজ্জাক অভাবের সংসারে তিন বেলা খাবার জোগাতে এখনো দিনমজুরের কাজ করেন। তার স্ত্রী শাহেনা বেগমও অনেক বছর ধরে ঝিয়ের কাজ করেন পরের বাড়িতে। এর পরও কুলিয়ে উঠতে না পেরে ছেলে মহিউদ্দিনকে হোটেল-মোটেল জোনের এক লন্ড্রিতে সহকারীর কাজে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে ২০১৭ সালের শেষের দিকে আবাসিক হোটেলে পিয়নের কাজ শুরু করেন মহিউদ্দিন। মাইনে পেতেন মাত্র কয়েক হাজার টাকা। কিন্তু গত তিন বছরের ব্যবধানে রহস্যজনকভাবে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন নিকট অতীতের ‘পিয়ন মহিউদ্দিন’।

জেলার হোটেল-মোটেল জোনে তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শতাধিক বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সম্প্রতি এসব তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর তাকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের। তার অর্থের উৎস কী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সূত্রমতে, হোটেল-মোটেল জোনে প্রায় শতাধিক বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট মোটা অংকের বিনিময়ে বন্ধক ও বিভিন্ন মেয়াদে ভাড়া নিয়েছেন মহিউদ্দিন। এসব ফ্ল্যাট ব্যবসায় তিনি অন্তত ৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও নামে-বেনামে তার রয়েছে আরও অনেক সম্পদ। নাম প্রকাশ না করে এসব ফ্ল্যাটের মালিকপক্ষের কয়েক জন জানান, তার নিয়ন্ত্রণে থাকা ফ্ল্যাটের মধ্যে ২০-৩০টি মহিউদ্দিন ১০-২০ লাখ টাকায় বন্ধক হিসেবে নিয়েছেন। বন্ধক থাকায় এসব ফ্ল্যাটের ভাড়া দিতে হয় না। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অগ্রিম দিয়ে মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকায় মাসিক ভাড়া নিয়েছেন। এসব ফ্ল্যাটের জন্য তার প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়া অন্তত পাঁচটি ফ্ল্যাট মহিউদ্দিন কিনে নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তারা। এসব ফ্ল্যাটের মধ্যে অন্তত ৫০টি ফ্ল্যাট রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক এনজিও সংস্থায় কর্মরত বিদেশিদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন।

মহিউদ্দিনের বাবার নিবাস মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল খালেক জানান, মহিউদ্দিন রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেলেও সংসার চালাতে তার বাবা এখনো দিনমজুরি করছেন। মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। মহিউদ্দিন মহেশখালীতেও কোটি টাকা মূল্যের কয়েকটি জায়গা কিনেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে তার অর্থের উৎস সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেননি এ জনপ্রতিনিধি।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের ব্যবসায়ীদের দাবি, করোনাকালে পর্যটন বন্ধ থাকায় লোকসানের কারণে যেখানে অনেকেই হোটেল-ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, সেখানে মহিউদ্দিনের চিত্র ছিল ভিন্ন। তিনি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ জামানত ও চড়া ভাড়ায় ৩০ থেকে ৪০টি ফ্ল্যাট নিজের কব্জায় নিয়েছেন। এতে রীতিমতো বিস্মিত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তার গায়েবি আয়ের উৎস তদন্তের দাবি জানিয়ে তাদের অনেকেই মহিউদ্দিন ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ফোনে জানতে চাইলে আর্থিক অনটনে বিভিন্ন হোটেলে চাকরি করেছেন স্বীকার করে মহিউদ্দিন বলেন, ‘মানুষের কি টাকা-পয়সা হতে পারে না? আমারও হয়েছে। আমি বিদেশিদের ৩০টি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছি। একটি ফ্ল্যাট গড়ে ৫০ হাজার করে সেখান থেকে অন্তত ১৫ লাখ টাকা মাসে আয় হয় আমার।’ তিনি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন দাবি করলেও এতসংখ্যক ফ্ল্যাট ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের উৎস সম্পর্কে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এদিকে ফোন কেটে দেওয়ার পর ঢাকার এক সিনিয়র সাংবাদিককে দিয়ে নিউজটি প্রকাশ না করতে প্রতিবেদকের কাছে তদবির করান মহিউদ্দিন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের যে কয় জনের আয়ের উৎসের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে মহিউদ্দিনের নাম রয়েছে। আয়কর অফিসে তার ফাইল আছে কি না তা যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মহিউদ্দিনের মাদকসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। প্রমাণ পেলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।