পুলিশ স্ত্রী আর সাংবাদিক স্বামীর ভালোবাসার গল্প
গল্পের শুরুটা আজ থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে। ২০০১ সালে। দু’জনই তখন একই কোচিং সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেখান থেকেই পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব আর সেই বন্ধুত্বের পথ ধরে দু’জন হয়ে গেলেন আজীবন পথ চলার সঙ্গী।
বর্তমানে তারা দু’জনেই রয়েছেন চ্যালেঞ্জিং পেশায়। একজন সাংবাদিকতায়। অারেকজন পুলিশে। কারও চ্যালেঞ্জই কোন অংশে কম নয়। পেশাগত দিক থেকে কাজের মিল থাকায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলেছেন তারা। এক্ষেত্রেও তারা একে অন্যের পরিপূরক। যদিও সমাজে এক প্রকার ধারনা অাছে সাংবাদিক-পুলিশ একে অপরের শত্রু।
কিন্তু এ বিষয়টিকে পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করেছেন আশরাফুল ইসলাম কচি ও কাজী লিমা দম্পতি। পেশাগত কারণে দু’জনকে থাকতে হচ্ছে দু’জায়গায়। তারপরও যখনই সেময় পান চেষ্টা করেন একে অন্যকে সময় দিতে। একান্ত সাক্ষাৎকারে তারা জানিয়েছেন নিজেদের চ্যালেঞ্জগুলোর কথা, শুনিয়েছেন তাদের সফলতার গল্প।
আশরাফ কচি কর্মরত আছেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের জয়েন্ট নিউজ এডিটর হিসেবে। যদিও তার এই অবস্থান একদিনে তৈরি হয়নি। সেখানে পৌঁছাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। পদে পদে এসেছে বাধা, এমনকি হত্যার হুমকিও। তবুও পিছু হটেননি তিনি। বরং সাংবাদিকতার মতো একটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় গড়েছেন নিজের ক্যারিয়ার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন কচি। বিভাগের বড় ভাই মোশতাক, কবির ও ইশতিয়াক ভাইয়ের পরামর্শে আসেন সাংবাদিকতায়। শুরুটা দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকা দিয়ে। সেখানে ১০০০ টাকা বেতনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। আর তখন থেকেই হাত খরচের টাকা বাড়ি থেকে আনতে হয়নি তাকে।
সাংবাদিকতার শুরু থেকেই বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। তবে সাহসিকতা ও উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করেছেন সব। ১/১১ এর মতো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সময় নবীন এ সাংবাদিক টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেলে। তবে শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে সে অবস্থাতেই পেশাগত দায়িত্ব পালনে ছুটে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তখন খুব কঠিন সময় পার করতে হয়েছে তাকে। এছাড়া ডাকসু ভবনের পাশে ছাত্রশিবির ক্যাডারদের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা, সেনাবাহিনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাদকের বিস্তার এবং তার সমর্থনে থাকা রাঘববোয়ালদের নামে সংবাদ প্রকাশ করে সবার চোখে পড়ে যান কচি।
তার পেশাগত জীবনের শুরু দৈনিক সংবাদ দিয়ে। এরপর দৈনিক সমকাল তারপর আরটিভি হয়ে আসেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে।
সাংবাদিক-পুলিশ দম্পতির দিন কেমন কাটে? এমন প্রশ্নে হেসে উত্তর দেন কচি। বলেন: আগে শুনতাম সাংবাদিক-পুলিশ ঠিক বনেনা। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা বৈরী। কিন্তু সংসার জীবনে এসে দেখলাম ঠিক তার উল্টো, বরং পেশাগত বিভিন্ন বিষয়ে মিল থাকায় একে অন্যের সাথে আলাপ-অলোচনার মাধ্যমে সহজ হয়ে যায় অনেক কিছু।
দেশের কোথাও বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক একে অপরকে জানিয়ে দেন। দু’জনের পেশাটাই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে একে অপরের সাথে আলোচনার মাধ্যমেও সিদ্ধান্ত নেন অনেক বিষয়ে।
ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে কচি বলেন, এই পেশায় আসতে হলে সাংবাদিকতাকে ভালবেসেই আসতে হবে। অনেক বাধা আসবে কিন্তু পেশাটা অনেক চার্মিং। মেধাবী ও সৎ ছেলে-মেয়েরা যতো বেশি এ পেশায় আসবে এ পেশার সুনাম ততো ছড়িয়ে পড়বে।
এই দম্পতির আরেকজন কাজী মাকসুদা লিমা। যিনি তৃণমূল পর্যায়ে থেকে কাজ করে চলেছেন মানুষের জন্য। ৩০তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। বর্তমানে কর্মরত আছেন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান সার্কেলের সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে। সবকিছুর ওপরে প্রাধান্য দেন নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বকে। আসামি ধরতে সিদ্ধহস্ত সাহসী এ নারী পুলিশ কর্মকর্তা সাহসিকতার নিদর্শনস্বরূপ পেয়েছেন ‘বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ অ্যাওয়ার্ড -২০১৬’।
কচি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল করায় তার সঙ্গে ভাব করতে গিয়েছিলেন লিমা। আর সেই থেকেই শুরু। ওই একদিনের কথার কারণেই এখন সংসার করতে হচ্ছে বলে হেসে জানালেন লিমা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী লিমা। চ্যালেঞ্জিং জব পছন্দ হওয়ায় বেছে নেন পুলিশের চাকরি। বিসিএসে সফল হয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। ট্রেনিং পিরিয়ডের দিনগুলোতে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক বেশি কষ্ট হলেও দিনগুলো লিমার অনেক বেশি প্রিয়।
লিমা হেসে বলেন: সবসময় অপেক্ষায় থাকতাম বৃষ্টির যেনো মাঠে নামতে না হয়। তবে সারদার আকাশে বৃষ্টি খুব কমই হতো। সে সময়টা মুঠোফোন ব্যবহারে কিছুটা নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় সারদার ব্যাচমেটগুলোকে মনে হতো অনেক বেশি আপন।
নিজেদের সম্পর্কের বিষয়ে লিমা বলেন, আমার স্বামী-স্ত্রীর চেয়ে বন্ধু বেশি। তবে বন্ধু হওয়াতে প্রায়ই বিড়াম্বনার শিকার হতে হয়। আর তাই মা-বাবা বা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যখন স্বামীর নাম ধরে ডেকে ফেলেন বা তুই বলে ফেলেন। পরক্ষণেই আবার তা সংশোধন করে নিতে হয়।
কর্মক্ষেত্রে সফলতার পেছনে তার সাংবাদিক স্বামীর অবদান অবলীলায় স্বীকার করে নেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। একে অপরকে সময় দিতে না পারলেও বা পেশাগত কারণে সংসারটা ঠিকমতো করা না হয়ে উঠেলেও, এ নিয়ে অভিযোগ নেই সাংবাদিক স্বামীর।
ঝালকাঠির মেয়ে লিমা পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান চাকরিতে যোগদানের আগে সব পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারলেও এখন বঞ্চিত তার সবকিছু থেকেই। এরপরও যখনই সুযোগ পান চেষ্টা করেন একে অন্যকে সময় দিতে।
এ দম্পতির কর্তব্য যেনো ২৪ ঘণ্টার। দেশের ও মানুষের নিরাপত্তা বিধানই তাদের কাজ। আর তাই দেশের অন্য পেশায় নিয়োজিতরা যখন নিজেদের মুঠোফোনটি বন্ধ করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন, তখন এ দম্পতি অতন্দ্র প্রহরীর মতো সতর্কবস্থানে থাকেন। দু’জনেই চান নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে যেতে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন