পেষাই করা হলো চুয়াডাঙ্গার কৃষকদের

কৃষের বাটা যায় সবদিকে। চাষাবাদ করতে সেচকাজসহ সার কীটনাশকের যেসব প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে-সেসব জিনিসের দাম বেশি হওয়ার কারণে দেখা যায়, খরচ আর উৎপাদন আলাদা করলে বেশিরভাগ সময়ই কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

পানির কারণে ভুগতে হয় বেশিরভাগ সময়। দেখা যায় সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ বন্যা হলেও চুয়াডাঙ্গায় বন্যাকবলিত এলাকা হিসেবে ভিন্নতা রয়েছে। বিভিন্ন কার্যত ক্ষেত্রে চুয়াডাঙ্গায় বন্যার আশঙ্কা খুবই কম দেখা যায়। সেইহিসেবে এ জেলা বন্যার ফাঁদে না পড়লেও গত ৪/৫ দিনের টানা ভারি বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় বিভিন্ন সবজি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

আশ্বিন মাসের পড়া শুরু করলেও শীতের মাস হলেও শীত এখনও পড়েনি ঠিকই কিন্তু আগাম শীতের সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, মরিচ, রোপা আমন ধান, মাসকলাই, কলাসহ গ্রীস্মকালিন সবজি ও পান বরজে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

আজ (১৮ সেপ্টেম্বর) বুধবার চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে টানার বৃষ্টির ছোবলে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন আমাদের চোখে পড়েছে। যে ক্ষয়ক্ষতিতে এবার চুয়াডাঙ্গার কৃষকদের শীতকালীন সবজির বাজারজাতকরণে দারুণভাবে ধাক্কা খেতে পারে। এতে করে শীতকালীন সবজিও দাম বাড়তে পারে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

চারদিনে ক্ষতিকারক বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ২৩৮ মিলিমিটার। তবে, এখনো পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরুপণ করতে পারেনি কৃষি বিভাগ।

সরেজমিনে গিয়ে কথা হয়, দামুড়হুদা উপজেলার ল²ীপুর গ্রামের কৃষক সুমন হোসেরে সাথে। তিনি এবার চাষে সাফল্য পাবে বলে লালিত স্বপ্নে বিভোর হয়ে ২ বিঘা জমিতে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ফুল কপি রোপণ করেছিলেন।

কিছুদিন পর এক টানা চারদিনের বৃষ্টিতে কপিক্ষেতের গাছের গোড়াই পানি জমে পচন সৃষ্টি হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষক সুমনের স্বপ্ন ধুয়ে গেছে টানা ভারি বর্ষণের কারণে। একদিকে আকাশ আর অন্যদিকে মাঠভরা ফসলের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সুমন। আর দুচোখ দিয়ে সেই বৃষ্টির মতো পানি ঝরছিলো দুচোখ দিয়ে।

প্রায় সবারই কৃষক সুমনের মতো অবস্থায় তারিক রহমানেরও। দুই বিঘা জমিতে পেঁেপ গাছ লাগিয়েছিলো। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিতে মাঠের প্রায় অর্ধেক পেঁেপ গাছ নষ্ট হয়ে ভেঙে গেছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ টাকা।

এদিকে, মাঠভরা ক্ষতি হয়েছে উঠতি ফসল রোপা-আমন ধানের। পরিচর্যা করে যখন ধান ঘরে তোলার সময় ঠিক সেসময় ওই বিধ্বংসী টানা অবিরাম বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে রোপা-আমনের পাকা ধান।

কৃষকদের প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ১৬ হাজার টাকা। তার এবার ২০ থেকে ২২ মণের মতো ধান উৎপাদন হতো। কিন্তু ধান তোলার শেষ মুহূর্তে এ দুর্যোগের কারণে এবার রোপা আমন ধানের কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কৃষক। মাঠের একটা মরিচ গাছও অক্ষত নেই-সবই মারা গেছে। টানা বৃষ্টির ছোবল থেকে রেহাই পায়নি অর্থকরি ফসল পান বরজও। ব্যাপক ক্ষতি দেখা গেছে তাতে। পান বরজের প্রতেকটা লাইনের পান গাছ ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছে। মাঠে পানি জমে থাকায় পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফুলকপি ও কুমড়া।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গেলো ওই চারদিনের টানা বৃষ্টি আর দমকা ঝড়ো হাওয়ায় মাঠ ফসলে ক্ষতিতে আক্রান্ত হয়েছে যেসব ফসল-রোপা আমন ধান ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। গ্রীস্মকালিন সবজি ১ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে। মরিচ গাছ ১২০ হেক্টর জমিতে। মাসকলাই ১৬৫ হেক্টর জমিতে। পেঁপে গাছ ২২৫ হেক্টর জমিতে। কলা ৭৫ হেক্টর জমিতে। এবার এই জেলায় মোট রোপা আমন ধান উৎপাদন হয়েছে ৩৬ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে। গ্রীস্মকালিন সবজি ৯ হাজার ৫৩১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য চুয়াডাঙ্গার কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মিরা কাজ করছে।

চুয়াডাঙ্গা গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কৃষক হাসু মিয়া বলেন, গেলো এই বৃষ্টিতে ১০ বিঘা জমিতে ফুলকপি পানির নিচে ডুবে আছে। প্রত্যেকটা গাছে পচন ধরে নষ্ট হয়ে যাবে। এখানে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়ে যাবে। তবে এই ক্ষতি মানতে পারছে না কৃষক। মাঠকে মাঠ পানি বেঁধে থাকায় সবজিতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা আর বলার মতো নয়। এখন এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় কষ্ট কৃষকের।

লক্ষপুর গ্রামের কৃষক সুমন হোসেন বলেন, বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর মাঠে এসে দেখছি মাঠের সব ফসল পানির নিচে। উঠতি ধান পানির নিচে পড়ে আছে। এই পাকা ধানে এখন পানির নিচে পড়ে থেকে ধানের দানায় কল বেড়িয়ে যাবে। মরিচ গাছ তো সব মরে যাবে। পেঁপে গাছ আর পান বরজ সব নষ্ট হয়ে যাবে। মাঠের তো অর্থকরি ফসলের মধ্যে গ্রীস্মকালিন সব ধরনের সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছে।

এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, এই বৃষ্টিতে মাঠ ফসলে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। রোপা আমন ধানে বৃষ্টির পানিতে ক্ষতির আক্রান্ত হয়েছে। আর পেঁপে গাছ ঝড়ো বাতাসে গাছগুলো ভেঙে গেছে। তাতে করে এই জেলায় এবার গেলো বৃষ্টিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, মরিচ, মাসকলাই, কলাসহ গ্রীস্মকালিন সবজি ও পান বরজে ক্ষতির আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ১শ’ হেক্টর ফসলি জমি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ চলছে।