প্রতিদিন পুলিশের বিরুদ্ধে নাগরিকদের ২০ অভিযোগ
রাস্তায় গাড়ি আটকে কাগজপত্র দেখার নামে ঘুষ চাইছে পুলিশ। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ফোন করে বিষয়টি জানিয়ে দিলেন এক ব্যক্তি। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ফোন গেলো ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে।
এটা কোনো গল্প নয়। বাংলাদেশেই পুলিশ সদস্যদের অন্যায্য আচরণ, নাগরিকদের সঙ্গে, দুর্ব্যবহার, মারধর ঘুষ চাওয়া বা অন্য কোনো ধরনের অভিযোগ থাকলে ফোন করেই তা জানিয়ে দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর অভিযোগের আলোকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চলে তদন্ত। প্রমাণ হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা এমনকি মামলা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পুলিশ বাহিনীকে আরও জনবান্ধব করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৩ নভেম্বর থেকে নাগরিকদের থানায় উপস্থিত না হয়ে ঘটনাস্থল বা অন্য জায়গা থেকে সরাসরি অভিযোগ জানানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেদিন পুলিশ সদর দপ্তর চালু করে ‘আইজিপিস কমপ্লেইন সেল’। এই সেলে ফোন করে বা ই-মেইল করে অথবা কুরিয়ারে চিঠি লিখে অভিযোগ জানানো যাবে। আর দিনের কোনো নির্ধারিত সময় না রেখে ২৪ ঘণ্টার যে কোনো সময় অভিযোগ জানানোর সুযোগ রেখেছে পুলিশ।
এই অভিযোগ জানানোর সুযোগ চালুর পর গত তিন সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে অভিযোগ জমা পড়ছে পুলিশ সদর দপ্তরে। এই ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি এখনও সেভাবে প্রচার পায়নি, তারপরও যেভাবে অভিযোগ আসছে, তাতে পুলিশ সদস্যদের একটি বড় অংশই যে নাগরিকদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে না সেটি স্পষ্ট।
আইনশৃঙ্খলা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং বিপদে পড়লে তাদের উদ্ধারে কাজ করে পুলিশ বাহিনী। জনমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাহিনীটির সদস্যদের প্রাণের ঝুঁকি নেয়া এমনকি প্রাণ দেয়ার ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেই আবার চাঁদাবাজি, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অপরাধীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়ানো এমনকি অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাতেও পুলিশ সদস্যদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে ভুরি ভুরি। আছে থানায় আটকে রেখে টাকা আদায়, মামলার জড়ানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মতো অভিযোগও।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে হলে এতদিন থানায় গিয়ে অভিযোগ বা আদালতে গিয়ে মামলা করা ছাড়া বিকল্প ছিল না নাগরিকদের। কিন্তু ‘আইজিপিস কমপ্লেইন সেল’ সে সুযোগ করে দিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযোগ জানানোর সেলটি একজন অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদ মর্যদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে আসা প্রতিটি অভিযোগেরই তদন্ত হয়।
চালু হওয়ার পর থেকে দিনে কম করে হলেও ১৫টি আর সর্বোচ্চ ২৫টির মত অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেলের কর্মকর্তারা।
অভিযোগ পাওয়ার পর কী করা হয়, এমন প্রশ্নে সেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, যে এলাকা থেকে অভিযোগ এসেছে, সেই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করা হয়ে থাকে। ঘটনা প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে পরে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়ে থাকে। কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে কাউকে ফাঁসাতে অভিযোগ করেছেন কি না, এই বিষয়টিও তদন্তে খতিয়ে দেখা হয়।
কী ধরনের অভিযোগ বেশি আসছে-এমন প্রশ্নে সেলের একজন কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত পাওয়া অভিযোগের বেশিরভাগই এসেছে ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে। গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় তাদের আচরণের সন্তুষ্ট না হয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। এর বাইরে দুর্ব্যবহার, আইনি সুরক্ষা দিতে অনীহা, হুমকি বা অবৈধ টাকা আদায়ের বিষয়ে অভিযোগ আসছে।
তবে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, তার একটিরও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস বলেন, আমরা প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে অভিযোগ পাই। প্রতিটিরই তদন্ত করা হচ্ছে বা হবে। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে, তাদের সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রতিটি অভিযোগই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হলেও প্রতিটি অভিযোগের পরই ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কারও অভিযোগই আমরা ফেলে রাখি না। আমরা সবগুলোই খতিয়ে দেখি।’
যেভাবে অভিযোগ করা যাবে
পুলিশ জানিয়েছে ‘আইজিপিস কমপ্লেইন সেল’ এ অভিযোগ করতে কোনো জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হবে না। সার্বক্ষণিক চালু থাকা ০১৭৬৯৬৯৩৫৩৫ অথবা ০১৭৬৯৬৯৩৫৩৬ মোবাইল নম্বরে কল করে অভিযোগ করা যাবে। তবে যিনি অভিযোগ করেছেন তার ফোন নম্বরটা যেন চালু থাকে। কারণ তার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করার দরকার পড়তে পারে।
এছাড়া অনলাইনেও অভিযোগের সুযোগ রাখা হয়েছে। [email protected] তে মেইল করে জানানো যাবে অভিযোগের বিস্তারিত।
এর বাইরে পুলিশ সদর দপ্তরে ‘আইজিপি কমপ্লেইন সেল’ বরাবর চিঠি পাঠিয়েও অভিযোগ করতে পারবেন যে কোনো ভুক্তভোগী।
উদ্যোগ ভালো, কঠোর ব্যবস্থা তাগিদ
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান।
এই শিক্ষক বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এই সেল চালু অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। যতদূর জানি আইজিপি নিজেই তদারকি করছেন। কাজেই তার সার্ভেলেইন্স কাজ করবে। তবে কেবল পর্যক্ষেণ নয়, এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যবস্থা। পুলিশ বাহিনীর ৭০ হাজার সদস্যের বিরুদ্ধেই কোনো না কোনো অভিযোগ আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে চাকরিচ্যুতি বা ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েছে কমই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা বলতে কেবল ক্লোজ করা বা বদলি করা হয়। এটাই সমস্যা। পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তির জায়গাটা দুর্বল। শাস্তি আরও কঠোর হওয়া উচিত। তাহলেই এই উদ্যোগের সুফল মিলবে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন