প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ৮ সিন্ডিকেট!
প্রশ্নপত্র ফাঁসের নেতৃত্বে রাজধানীভিত্তিক ৮টি সিন্ডিকেট ও ৩০টি হাইস্কুল এবং কলেজের শিক্ষকরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি পরীক্ষার কেন্দ্রভিত্তিক সিন্ডিকেট ও তিনটি কোচিং সেন্টারভিত্তিক সিন্ডিকেট রয়েছে।
টাকার বিনিময়ে পছন্দমতো পরীক্ষার কেন্দ্র দেওয়ার সঙ্গে যু্ক্ত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা, বেসরকারি শিক্ষক সমিতির কিছু নেতা এবং একাধিক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাণিজ্যিকভিত্তিতে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ পাসের হার এবং জিপিএ-৫ বাড়ানোর নেপথ্যে এই প্রশ্নফাঁস। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্কুল-কলেজগুলো প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা স্কুল (টপ টোয়েন্টি) নির্বাচন বন্ধ।
এ অবস্থায় স্কুলগুলোর ভালো-খারাপ নির্ধারণ হয় শতভাগ পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁস করিয়ে দিয়ে পাসের হার বাড়ানোর চেষ্টা করে ওই দুর্বৃত্তরা। আর প্রশ্ন ফাঁসকারী দুর্বৃত্তদের খপ্পরে পড়েন এক শ্রেণির নৈতিকতাহীন অভিভাবকরা। অভিভাবকরা মনে করেন, যে কোনো মূল্যে তার সন্তানকে জিপিএ-৫ পেতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরাই মূলত পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নপত্র ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করাসহ পরীক্ষায় পাসের হার বাড়াতে প্রশ্নফাঁস করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে সিন্ডিকেটে থাকা শিক্ষকরা।
টেলিভিশন ও পত্রিকা খুললেই বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে এমন কয়েকটি স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগে স্মার্টফোন উপহার দেয়া হয় প্রতিষ্ঠান থেকেই। ওই ফোনগুলো সচল রাখতে বলা হয় পরীক্ষার আগের রাত থেকে সকাল অব্দি।
বাণিজ্যিকিভিত্তিতে গড়ে ওঠা ওইসব চটকদার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কোন কেন্দ্রে পরীক্ষা দেবেন তা ঠিক করতে ঘুষ নেয় ঢাকা বোর্ডের কিছু কর্মকর্তা। ওইসব প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার্থীরা সাড়ে তিনঘন্টাও পরীক্ষা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বোর্ডের কোনো কর্মকর্তা আজ পর্যন্ত ওই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা পরিদর্শনে যাননি। টেলিভিশনসহ বড় বড় পত্রিকাগুলোও ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করে না।
অনুসন্ধানে জানায় যায়, ঢাকা মহানগরীর জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে চারটি সিন্ডিকেট। বেশ কয়েকটি শিক্ষক সমিতির নেতা এবং বড় বড় স্কুলের প্রধান এসব সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন। এগুলো হচ্ছে- যাত্রাবাড়ী সিন্ডিকেট, মতিঝিল সিন্ডিকেট, উত্তরা সিন্ডিকেট ও মিরপুর সিন্ডিকেট।
ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছর সাভারের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ শাহরিয়ার মেনজিসের মাধ্যমে রাজধানী ও এর আশেপাশের বেশ কিছু স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষকদের কাছে প্রশ্নপত্রের ছবি পৌছেছে।
প্রশ্নপত্রের ছবি পাঠানোর তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর মতিঝিল কলোনি হাই স্কুল, কমলাপুর রেলওয়ে স্কুল অ্যন্ড কলেজ, মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মানিকনগর আইডিয়াল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ ও শাহজাহানপুর রেলওয়ে হাইস্কুলসহ আরো বেশ কয়েকটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
এছাড়া ঢাকার বাইরের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাভার ও আশুলিয়ার দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে গাজীপুরের কোনিয়া ও অভিনব কোচিং সেন্টার, মানিকগঞ্জের জয় একাডেমি এবং জ্ঞানকোষ একাডেমিসহ আরো বেশ কয়েকটি এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রয়েছে।
এছাড়া আশুলিয়ার সৃষ্টি শিক্ষা পরিবার নামে একটি কোচিং সেন্টারের সারাদেশে ১৫টি শাখাও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। মেনজিসকে ভৈরবের উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়ছে গত বছর।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় যেসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার কেন্দ্র হবে তা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নির্ধারণ করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাঠায় যাত্রাবাড়ী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের দোসর শিক্ষা বোর্ডের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ওই রিপোর্টের আলোকে দ্রুতগতিতে পরীক্ষা কেন্দ্রের অনুমোদন দেন।
এতে দেখা গেছে, এমন কিছু কেন্দ্র রয়েছে যেখানে প্রশাসন দূরে থাক পুলিশও সময়মতো পৌঁছাতে পারে না। এক সময় সেলিম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে যাত্রাবাড়ী সিন্ডিকেট পরিচালিত হতো। এখন আবু বকর ও সাদ আহমেদসহ অন্যদের মাধ্যমে হচ্ছে। একইভাবে মতিঝিল সিন্ডিকেটেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পছন্দমতো পরীক্ষা কেন্দ্র নির্ধারণ করা হলে স্ব স্ব স্কুলের পাসের হার বাড়াসহ জিপিএ-৫ পাওয়ার পরিসংখ্যান বেশি হয়। এতে শিক্ষা বোর্ডসহ বিভিন্ন স্থানে ভালো ফলাফলধারী স্কুলের মর্যাদা বাড়ে।
আর মর্যাদা বাড়লে বছরের শুরুতে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এর ফলে ভর্তিতে মোটা টাকার ব্যবসা হয়। এ জন্য জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলকে ‘পাখির চোখ’ করে রাখে স্কুলগুলো।
ঢাকা শহরে এমন স্কুল রয়েছে প্রায় ২৫টি। এই ২৫টি স্কুলে যদি কড়া নজরদারি চালানো হয় তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে বলে বহু সচেতন নাগরিক মন্তব্য করেছেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার পুরানা পল্টনে একই ক্যাম্পাসে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সেগুনবাগিচা হাইস্কুল ও বেগম রহিমা নামে দুটি হাইস্কুল রয়েছে। এর মধ্যে সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র এক স্কুলে আর রহিমা হাইস্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্র পড়েছে কমলাপুর রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে।
সেগুনবাগিচা হাইস্কুল মতিঝিল সিন্ডিকেটে না থাকায় তাদের কেন্দ্রও দূরে পড়েছে এবং পাসের হারও কম। একইভাবে রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরা এলাকায়ও এভাবে পরীক্ষার কেন্দ্রভিত্তিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটগুলোর কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। অথচ সরকার এসব সিন্ডিকেট ভাঙছে না।
পরীক্ষা কেন্দ্র সিন্ডিকেটের বাইরে রয়েছে কোচিং সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে ঢাকায় অন্তত এরকম তিনটি কোচিং সিন্ডিকেটের খবর পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে- মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং ফার্মগেটভিত্তিক কোচিং সিন্ডিকেট।
এসএসসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সরকার কোচিং সেন্টার বন্ধ করলেও এসব এলাকার কোচিং কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। এসব কোচিং সেন্টার থেকেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সন্দেহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি মতিঝিল এলাকার এজিবি কলোনিতে প্রতিভা কোচিং সেন্টারও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া সরকার বলছে, পরীক্ষা কেন্দ্রে কোনো ধরনের স্মার্টফোন ব্যবহার করা চলবে না। কিন্তু সরকারের এই নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না।
এর বাইরেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্য আরেকটি কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। সেটি হলো- একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থী হিসাব করে একটি প্যাকেটে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সব প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। প্রশাসনের উপস্থিতিতে কেন্দ্র সচিব অফিসে বসে প্যাকেট খুলে হলভিত্তিক প্রশ্ন গুনে দেন। প্রশ্ন গোনার পর আর প্যাকেট করা হয় না। পিয়নদের মাধ্যমে এই প্রশ্ন হলগুলোতে পাঠানো হয়।
কেন্দ্র সচিবের অফিস থেকে পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত প্রশ্নের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে। সেখান থেকে অন্যরা এটিকে সর্বজনীন করে তোলে। এই জায়গায় সরকার কোনো নজরদারি করছে না।
এ ছাড়া ৭/৮ বছর ধরে একই শিক্ষা বোর্ডে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রশ্নফাঁসে সহায়তা করছেন। পরীক্ষা কেন্দ্র সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া এবং ঢালাওভাবে পরীক্ষা কেন্দ্র অনুমোদন দেয়ার নেপথ্যেও ওই কর্মকর্তারা রয়েছেন।
এদের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে নীরব থেকেছে।
পুরান ঢাকার আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাদ আহমদ। তার ছেলে পরীক্ষা দেয় অপর একটি কেন্দ্রে। সাদ আহমদ প্রতিটি পরীক্ষার আগে তার স্কুলে আসেন স্মার্টফোন হাতে। লালবাগের থানা শিক্ষা অফিসার রিয়াজ হোসেন সাদের বন্ধু। তিনি উপস্থিত থাকেন। মন্ত্রণালয়ের একটি পরিদর্শন টিমের হাতে গত সপ্তাহে ধরাও পড়েন তারা। কিন্তু ঢাকা শিক্ষা বোডের একজন নারী কর্মকর্তার কারণে সাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
একইভাবে রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে স্মার্টফোন হাতে নিয়ে পরীক্ষার ডিউটি করতে যান ওই এলাকার শিক্ষা কর্মকর্তা। অথচ পরীক্ষা কেন্দ্রে স্মার্টফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, সরকারকে বিপদে ফেলতে একাধিক সিন্ডিকেট প্রশ্নফাঁস করে ফেসবুকে দিয়ে দেয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে মন্ত্রণালয় বিশেষ করে শিক্ষা বোর্ডকে কঠোর হতে হবে। ঠিকঠাকভাবে মনিটরিংসহ পরীক্ষার কেন্দ্র সুবিন্যস্ত করলে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হবে। তার মতে, প্রশ্নপত্র ফাঁসে হয়তো এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ ও নামধারী শিক্ষক জড়িত। এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য এদেরকে পাকড়াও করতে হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন