বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতাই ঐতিহাসিক ৬ দফা : ব্যারিস্টার ফারজানা ছাত্তার এমপি

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও জাতীয় সংসদ সদস্য এবং ঈশ্বরগঞ্জের গৌরব ব্যারিস্টার ফারজানা ছাত্তার এমপি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭জুন, ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস।বাঙালি জাতির স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক সম্মেলনে ঐতিহাসিক ৬ দফা উপস্থাপন করেছিলেন। বাংলার গণমানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে ঐতিহাসিক ৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম ।বাংলার জনগণ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের পেলেও প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়। পাকিস্তানের অধীনে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আমরা বাঙালিরা ছিলাম বঞ্চিত-নিষ্পেষিত। শিক্ষা থেকে শুরু করে চাকুরি কিংবা খেলাধুলা, কোনো ক্ষেত্রেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সমান সুযোগ-সুবিধা পাইনি। রাষ্ট্রভাষার জন্যও আমাদেরকে রাজপথে রক্ত দিতে হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে পেশ করা হয় মাইলফলক দাবি ৬ দফা। বঙ্গবন্ধু ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ৬ দফায় যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছিলেন সেগুলো হচ্ছে:
১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
৩. মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৪. রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা৬ দফার লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এতে পৃথক সেনাবাহিনী, পৃথক মুদ্রা, পৃথক কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রেমিটেন্স, রাজস্ব ও বাণিজ্যে পূর্ণ অধিকারের দাবি তোলা হয়। পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা ছাড়া কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ না থাকা বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাময় রাজনৈতিক চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ। এটি ছিল পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে অগ্রগামী করার অনন্য রাজনৈতিক মহাকাব্য। ৬ দফার দাবিগুলো বিবেচনা করলেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু ওতপ্রোতভাবে জড়িত।বঙ্গবন্ধুর জন্য ৬ দফা ঘোষণার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু জনগণের মুক্তির চিন্তাই বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনায় প্রাধান্য পেয়েছিল। তাই ৬ দফা ঘোষণার পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সারা বাংলাদেশ ছুটে বেড়ান জাতির পিতা। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ৬ দফা দাবির পরিণতি অনুধাবন করেই পেশিশক্তি ও বন্দুকের মাধ্যমে ৬ দফা প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। এ সময় ৬ দফার মর্মবাণী সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে ৩৫ দিনে ৩৩টি জনসভা করেন বঙ্গবন্ধু। ৬ দফা আন্দোলনের ২ মাসের মধ্যে মোট ৮ বার গ্রেফতার হন তিনি, কিন্তু থেমে যাননি। জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবার ৬ দফার দাবিতে জনমত গড়েছেন, সংগ্রাম অব্যহত রেখেছেন। বাংলার জনগণের স্বাধিকার তথা ৬ দফার জন্য বঙ্গবন্ধুকে জীবনের মায়া ত্যাগ করে শুধু শাসকগোষ্ঠীর সাথে সংগ্রামই নয়, দলের ভেতর থেকেও প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল দলে। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্থানী আওয়ামী লীগের সকল নেতা এবং পূর্ব পাকিস্থানের আব্দুস সালাম খানসহ অনেক শীর্ষ নেতা আ.লীগ থেকে বেরিয়ে যায়। কেউ অন্য দলে যোগ দেয়, কেউ পিডিএম এর মত দল গঠন করে।কোনো বিরোধিতাকে আমলে না নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।শাসকগোষ্ঠী ও দলের অভ্যন্তরে বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল উপলক্ষ্যে আয়োজিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
“৬ দফার প্রশ্নে কোনো আপোষ নাই। রাজনীতিতে কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়, এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ৬ দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ৬ দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ৬ দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।”জনগণও বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়েছে অকুণ্ঠভাবে। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় ও ৯ মে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারে বাঙালিরা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৭ জুন দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেওয়া হয়। তৎকালীন গভর্ণর মোনামেয় খানের নির্দেশে ৭ জুন আওয়ামী লীগের মিছিলে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। গুলিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, মুজিবুল হকসহ অনেকে শহীদ হন। গ্রেপ্তার হন হাজার হাজার মানুষ।৭জুন জেলে বসেই বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন ৬ দফার সমর্থনে স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে এদেশের জনগণ। বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচা’য় ৭ জুন সম্পর্কে লিখেছেন- “১২ টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতষ্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছেন। তাঁরা ৬-দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তাঁরা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।”ছয় দফার প্রতি অবিচল ও আপোষহীন থাকার ফলেই ছয় দফা পরিণত হয়েছিল এক দফা তথা স্বাধীনতায়। বাংলার ম্যাগনাকার্টা ৬ দফা শুধু বাঙালীর মুক্তির সনদই নয়, ৬ দফা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও জনগণের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার প্রতিফলন। ৬ দফা ঘোষণার দিনের পরিবর্তে ৭ জুন ছয় দফা দিবস ঘোষণা করা জনগণের প্রতি অপরিসীম ভালবাসার দৃষ্টান্ত।