বনানীর ওসি ফরমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ওসি সালাউদ্দিন খান নিহত হওয়ার ৪৭ দিন পর বনানী থানায় নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগ দেন বিএম ফরমান আলী। সম্প্রতি দ্য রেইন ট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় আলোচনায় আসেন এই ওসি। তবে অতীতেও তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৪৯টি থানার মধ্যে বনানী থানার ওসি ফরমানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। পুলিশের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাই তাকে সমীহ করে কথা বলেন। নানা অভিযোগ থাকার পরও তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পান না কেউই।
বনানীর এই ওসি উত্তরা ক্লাবের ডোনার ক্যাটাগরির সদস্য (মেম্বারশিপ নম্বর ডিএম ৩৯৫)। ওই পদ নিতে গেলে কমপক্ষে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। একজন ওসি কিভাবে বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে উত্তরা ক্লাবের সদস্য হন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিলেও তখন কেউই তার কিছুই করতে পারেন নি।
শুধু তাই-ই নয়, গত বছরের আগস্ট মাসে বনানী থানায় যোগদানের পর থেকেই ঘুষ বাণিজ্য, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, ধর্ষণ মামলা না নেয়াসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ উঠে এই ওসির বিরুদ্ধে। সর্বশেষ বনানীতে দি রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগকারীদের চরিত্র হননের চেষ্টা করেন তিনি।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, মামলা করতে গেলে ওসি ফরমান আলী বিষয়টি নিয়ে নানা টালবাহানা করতে থাকেন। ধর্ষণের অভিযোগ জানানোর পরপরই ওসি বলতে থাকেন, ‘তোমরা কী নর্তকী? তোমরা কী হোটেলে গান গাও? সেটা না হলে হোটেলে যাবে কেন? টাকা নেওয়ার জন্য ওদের ফাঁদে ফেলতে চাও?’ এ সময় মোবাইল ফোনে দুই তরুণীর ছবি ধারণ করার আদেশও দেন তিনি।
তবে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশে মামলা গ্রহণ করার পর থেকে দৃশ্য পাল্টে যেতে থাকে। আলোচিত এ ঘটনার মধ্যেই পারিবারিক কারণ দেখিয়ে পাঁচ দিনের ছুটিতে যান ফরমান আলী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার ফেঁসে যেতে পারেন বনানীর এই ওসি। এরই মধ্যে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় বনানী থানার কর্তব্যে কোনো ধরণের অবহেলা আছে কিনা তা তদন্ত করতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএমপি।
গুলশান বিভাগ পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ বলেন, দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় বনানী থানার কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি বা অবহেলার দায় পুলিশ নেবে না। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে গাফিলতি কিংবা ভুক্তভোগী তরুণীদের হয়রানি করার প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর আগে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বনানীর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের তথ্য জানান। তিনি বলেন, বনানী থানার ওসির দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা আছে কিনা সেটি খুঁজতে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভিকটিমরা যেসব অভিযোগ করেছেন সেগুলো তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দেবেন।
কৃষ্ণপদ রায় আরো জানান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারকে (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি দু’জন হলেন, মহানগর গোয়েন্দার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার ও ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম)।
বনানীর ঘটনা ছাড়াও ওসি ফরমানের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
১. গত মার্চ মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওসিসিতে (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) ৮ দিন ভর্তি ছিল একটি মেয়ে। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কড়াইল বস্তির পাশে স্থানীয় চার যুবক তাকে তুলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে চলে যায়। ১৪ মার্চ মেয়েটি বনানী থানায় গিয়ে ওসি ফরমান আলীর সঙ্গে দেখা করেন। মামলা করার বিষয়ে একটি অভিযোগ তার হাতে দেন। ওসি সেটি পড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
মেয়েটির অভিযোগ, ‘ওসি বলেন, এইসব কাগজে কিছুই হবে না। মামলা নিয়ে আমরা বিপদে পড়বো নাকি। যতসব ফালতু অভিযোগ। স্বামীকে আনেন। স্বামী ছাড়া কোনো মামলা নেব না।’ পরদিন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থায় গিয়ে এ বিষয়ে অভিযোগ জানান ওই তরুণী।
তখন ওই অভিযোগের বিষয়ে ওসি ফরমান আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই মেয়ের কথাবার্তায় অসামঞ্জস্যতা আছে। তাই তাকে বলেছি তার স্বামীকে নিয়ে আসতে। স্বামীকে নিয়ে আসলেই মামলা নেয়া হবে বলেছি। কিন্তু, ধর্ষিতার স্বামীকে কেন লাগবে তার কোনো জবাব ওসি দিতে পারেননি।
২. কোনো অভিযোগ ছাড়াই ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় বনানী ঢাকা গেটের সামনে থেকে আনোয়ার নামে এক ব্যক্তিকে তার প্রাইভেট কারসহ আটক করে বনানী থানার এসআই সাইফুল ইসলাম। নিয়মানুযায়ী তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে থানায় সাধারণ ডায়রি অথবা মামলা দায়ের করতে হবে। কিন্তু থানায় আনার পর এসব কিছু না করে তার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়।
বলা হয়- টাকা না দিলে ইয়াবা মামলায় চালান দিয়ে দেয়া হবে। এরপর ঘুষ দিতে রাজি হলে আনোয়ারের এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে থানা পুলিশ। আর মোটা অংকের দান মারতে এসআই সাইফুল ছাড়াও একে একে এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হন ওসি ফরমান আলী, পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান ও বনানী ফাঁড়ির ইনচার্জ ইয়াসিন গাজী। পরে ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গুলশান ক্লাবের আশপাশে গিয়ে আনোয়ারের ওই বন্ধুর কাছ থেকে ঘুষের পুরো এক লাখ টাকা বুঝে নেন ওসি নিজে। পরদিন আনোয়ারকে নামেমাত্র মামলা (পুলিশের ভাষায় পাঁচ আনি মামলা) দিয়ে চালান করে দিয়ে আদালতের মাধ্যমে বের করে আনা হয়।
৩. গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব করভী মিজান অভিযোগ করেন যে, তিন বছর আগের একটি মিথ্যা মামলা ক্লোজ হয়ে যাওয়ার পরও ওই মামলায় তাকে হয়রানি করছে বনানী থানা পুলিশ।
তিনি বলেন, ‘একটি ভুয়া মামলা করা হলে তিন বছর আগেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেই। বাদী হাজির না হওয়ায় মামলাটি ক্লোজও হয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি বনানী থানার এসআই মামুন জানান, আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। সঙ্গে ঈদ সালামিও দাবি করেন।’
করভী মিজান আরো বলেন, ‘এরপর গত ১৯ সেপ্টেম্বর ফের ওয়ারেন্ট রি-কল করা হলেও পরদিন বনানী থানার নতুন ওসি ফরমান আলীর নির্দেশে আমাকে জোর করে থানায় নিয়ে যায় এসআই মামুন। সেখানে আমাকে হয়রানিও করা হয়। পরে আবারো আইনজীবীর মাধ্যমে সব কাগজপত্র জমা দেয়ার পর মধ্যরাতে আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
তখন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরমান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি করভী মিজানকে থানায় ধরে নেয়ার অভিযোগ স্বীকার করেন। তার দাবি মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি তিনি জানতেন না।-পরিবর্তন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন