বর্মাছড়িতে জোর করে ক্যাম্প স্থাপন ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দখলবাজি’ ছাড়া কিছুই নয়: চার সংগঠন
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার লক্ষীছড়ি উপজেলায় বর্মাছড়িতে এলাকাবাসীর আপত্তি সত্তে¡ও আর্য কল্যাণ বনবিহার ও পাহাড়িদের মালিকানাধীন জমি বেদখল করে সেনা ক্যাম্প স্থাপন প্রচেষ্টার প্রতিবাদ জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনরত চার গণতান্ত্রিক সংগঠন।
গত শনিবার(২৫শে অক্টোবর ২০২৫) সংবাদ মাধ্যমে দেয়া এক যুক্ত বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অমল ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা উক্ত প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে বর্মাছড়ি থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘যেহেতু স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তা বাহিনীর কোন ক্যাম্প দাবি করেনি এবং স্পষ্টই তারা সেখানে ক্যাম্প চান না, তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বর্মাছড়িতে জোর করে ক্যাম্প স্থাপনের কোন অধিকার নেই।’
জোরপূর্বক অন্যের জমি দখল করে বা বৌদ্ধ বিহারে জায়গায় সেনা ক্যাম্প স্থাপন ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দখলবাজি’ ছাড়া কিছুই নয় বলে তারা মন্তব্য করে বলেন, ‘তথাকথিত সন্ত্রাস দমন নয়, জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালানোর উদ্দেশ্যেই বর্মাছড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে।’
চার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বর্মাছড়ির জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্যাম্প স্থাপন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
এর আগে বর্মাছড়িতে আর্য কল্যাণ বনবিহারের জমি বেদখল করে সেনা ক্যাম্প নির্মাণ প্রচেষ্টার প্রতিবাদে ও মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের দাবিতে গণবিক্ষোভ করেছে বর্মাছড়ি এলাকাবাসী।
গত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকাল ১১টায় বর্মাছড়ি বাজার মাঠে আয়োজিত এই গণবিক্ষোভে এলাকার দুই হাজারের মতো জনগণ অংশগ্রহণ করে মিছিল ও সমাবেশ করেন।
প্রথমে তারা মিছিল সহকারে বর্মাছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করেন। এরপর বাজার মাঠে সমাবেশে মিলিত হন। মিছিল ও সমাবেশে তারা ‘সেনা ক্যাম্প চাই না” বলে শ্লোগান দেন এবং ক্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। গণবিক্ষোভে একাংশ অংশগ্রহণকারীদের সাধারন মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে।
সমাবেশে এলাকার বিশিষ্ট মুরুব্বী প্রদীপ চাকমার সভাপতিত্বে ও রনেল চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বর্মাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুইচালা চৌধুরী, ফটিকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উষাতন চাকমা, লক্ষীছড়ি উপজেলা মহিলা-ভাইস চেয়ারম্যান শিউলি মারমা, আর্য কল্যাণ বনবিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাবুল চাকমা ও সমাজকর্মী পাইচিউ মারমা। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সর্তা-বর্মাছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটির নেতা প্রহ্লাদ চাকমা।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, বর্মাছড়ি এলাকার পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত থাকার পরেও কেন এখানে সেনা ক্যাম্প দেওয়া হচ্ছে, সেটি সেটেলার সম্প্রসারন পুর্নবাসন প্রকল্প? এই সেনা ক্যাম্প নির্মাণ করা হলে বর্মাছড়ি এলাকার জনগণ মানবে না। তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জায়গা দখল করে সেনা ক্যাম্প নির্মাণ প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বক্তারা আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী জনগণের নিরাপত্তার কথা বললেও আদতে তারা জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন করে থাকে। ফলে জনগণকে সবসময় সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের ভয়ে আতংকে থাকতে হয়। এখনে সেনা ক্যাম্প স্থাপন হলে নারীরা অনিরাপদ হয়ে পড়বে। তারা বিহারে আসা-যাওয়া করতে পারবে না। বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল নিয়ে ক্যাম্প নির্মাণ স্থানে কিছুক্ষন অবস্থান নিয়েছেন।
সমাবেশ শেষে তারা মিছিল নিয়ে সেনাবাহিনী যেখানে ক্যাম্প নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে যেতে চাইলে পথিমধ্যে সেখান থেকে কিছুটা দূরত্বে সেনারা বাঁশের আড় দিয়ে ব্যারিকেড দেয়। এতে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় সেনা সদস্যদের অনেকে হেলমেট পরা অবস্থায় লাঠি হাতে ছিলেন।
ক্যাম্প নির্মাণ স্থানে যাবার পথে সেনারা পথে ব্যারিকেড দিলে বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে সেনাদের মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়।
পরে এলাকাবাসীর সাথে সেখানে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তা কথা বলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথাবার্তা বলার পর এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সেখানে ক্যাম্প নির্মাণ বন্ধ ও মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে উক্ত সেনা কর্মকর্তার নিকট চট্টগ্রামের চব্বিশ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির বরাবরে একটি সারকলিপি হস্তান্তর করেন।
এ সময় এলাকাবাসী সেখানে উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ক্যাম্প স্থাপনের কারণ জানতে চাইলে তারা উপরের নির্দেশে ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানান। অপরদিকে বিক্ষুব্ধ জনগণের পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধিরা ক্যাম্প স্থাপন করা হলে নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সেনা কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করা সময় এলাকারবাসীদের কাছ থেকে স্মারকলিপির রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করেছেন সেনা কর্মকর্তা।
জিওসির বরাবরে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে বলা হয়, ১। বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করা হলে তা ধর্মীয় পরিহানী হবে। ভিক্ষুদের ধ্যান কার্যে বিঘœ ঘটবে। ধর্মপ্রাণ দায়ক দায়িকাগণ ধর্মীয় কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিহারে আসতে ইতস্তঃতবোধ করবেন। ধর্মীয় পূজা-পার্বন, নানা উৎসবসহ বিহারের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে।
২। আমাদের এলাকায় কোন চুরি-ডাকাতি, খুন, চাঁদাবাজি, অবৈধ মালামাল বহন তথা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না। এলাকায় কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলে না। বর্মাছড়ি বাজারে পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকে না। আমরা উভয় সম্প্রদায় শান্তিতেই বসবাস করছি।
৩। বর্মাছড়ি এলাকার কাছাকাছি খিরাম ও শুকনাছড়ি আর্মি ক্যাম্প নামে দুটো সেনা ক্যাম্প রয়েছে। কাজেই নতুন করে সেনা ক্যাম্প স্থাপন মোটেই কাম্য নয় যা ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন। এ চুক্তিতে সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা ষ্পস্ট বিধি রয়েছে।
৪। আমরা জনগণের মতামত নিয়েছি। তারা কেউ ক্যাম্পের পক্ষে নয়। তারা ক্যাম্প চায় না।
৫। আর্মি ক্যাম্প হলে আমাদের মেয়েরা সম্পূর্ণ অনিরাপদ ও অরক্ষিত হয়ে যাবে। তারা একা একা আর কোথাও যেতে পারবে না। বাসায়ও একা একা থাকতে পারবে না। একা একা জঙ্গলে, জুমে, ঝরণা থেকে পানি আনতে, বাজারে যাওয়া আসা করতে ও প্রতিবেশির বাড়িতে প্রয়োজনে বেড়াতে যেতে পারবে না। তাদেরকে সব সময় যৌন হামলার ভয়ে থাকতে হবে। কারণ আপনারা সব সময় সব সৈন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এমন গ্যারান্টি দিতে পারবেন না।
৬। আমাদের এলাকায় কোন সন্ত্রাসী নেই। কেউ হয়তো আপনাদের কাছে ভালো সাজার জন্য, কিংবা আপনাদের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার জন্য সন্ত্রাসের ব্যাপারে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে থাকতে পারে। আমাদের এলাকায় চাঁদাবাজিও হয় না। এত ভেতরের এলাকায় কেউ চাঁদাবাজি করে না। চাঁদাবাজি হয় বড় রাস্তায়।
৭। যদি কোন সময় নিরাপত্তার দরকার হয়, আমরা নিজেরা এসে আপনাদের বলবো। আপনাদের সহযোগিতা চাইব। দয়া করে জনগণের অমতে অমানবিক ভাবে আমাদের এলাকায় ক্যাম্প দেবেন না।
উল্লেখ্য, গত কয়েকদিন আগে খিরাম আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল বর্মাছড়ি বাজার এলাকায় এসে আর্য কল্যাণ বনবিহারের জায়গায় কয়েকটি তাঁবু খাটায় এবং একটি স্থানে হেলিপ্যাডের চিহ্ন দিয়ে রাখে, যা সরকারে অহেতুক কোটি টাকার খরচে অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
গত ২২শে অক্টোবর সকাল থেকে তারা সেখানে ক্যাম্প নির্মাণের জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করে। শুক্রবার(২৪শে অক্টোবর) সকালে সেখানে আরো অন্তত ১৮০জন সেনা সদস্য উপস্থিত হয় এবং ড্রোন উড়িয়ে এলাকায় নজরদারি করে।
এমন পরিস্থিতিতে এলাকার বিক্ষুব্ধ জনগণ সেখানে ক্যাম্প স্থাপনের প্রতিবাদে ও মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের দাবিতে এই গণবিক্ষোভের আয়োজন করে। শুক্রবার(২৪শে অক্টোবর) সকালে বর্মাছড়ি বাজার এলাকায় সেনারা ড্রোন উড়িয়ে সাধারন গতিবিধি কড়া নজরদারি কওে রাখে।
বর্মাছড়ি আর্যকল্যাণ বনবিহারের পাশে চলছে অপ্রয়োজনীয় সেনা ক্যাম্প স্থাপনের পাঁয়তারা অভিযোগ উঠেছে। এতে ল²ীছড়ির বর্মাছড়িতে রাস্তা অবরোধ করে সেনাবাহিনীর টহল কার্যক্রম ব্যাহত করার চেষ্টার পাল্টা অভিাযোগ চলছে।
এক গ্রামবাসীর বাড়ি নির্মাণের প্রস্তুুতকৃত জায়াগায় জোর করে হেলিপ্যাডের চিহ্ন দিয়েছে সেনাবাহিনী। বর্মাছড়ি আর্যকল্যাণ বনবিহারের পাশের একটি জায়গায় চলছে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের পাঁয়তারা! সেখানে এক গ্রামবাসীর বসতভিটায় বাড়ি তৈরির জন্য প্রস্তুুতকৃত জায়াগায় ইতি মধ্যে দেওয়া হয়েছে হেলিপ্যাডের চিহ্ন। আশেপাশে খাটানো হয়েছে বেশ কয়েকটি সেনা তাঁবু।
গত বুধবার(২২শে অক্টোবর ২০২৫) সকাল থেকে সেনারা গ্রামবাসীর সৃজিত গাছের বাগান কেটে সেনা ক্যাম্প তৈরির জায়গা প্রস্তুত করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাগানের বেশকিছু সৃজন করা বেশ কিছু গাছ সেনারা কেটে দিয়েছে।
যে ভাবে হোক সেনা ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জায়গা প্রস্তুুত করতে গিয়ে গ্রামবাসীর সৃজিত বাগানের বেশ কিছু গাছ কেটে দেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ই অক্টোবর খিরাম আর্মি ক্যাম্প থেকে ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মো: সাইফুর রহমান তুর্যোর নেতৃত্বে ২০জনের একটি সেনা দল বর্মাছড়ি বাজার এলাকায় যায়। এরপর থেকে সেনারা উক্ত স্থানে তাঁবু খাটিয়ে রাখে। তবে রাতে তারা অবস্থান করেন ফটিকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে। শুকনাছড়ি সাব-জোন থেকে ২০জনের একটি সেনাদল হুদুকছড়িতে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। সেনারা উক্ত জায়গায়ও তাঁবু খাটিয়ে রেখেছে।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন




