বাঁশ ও কাঠের তৈরি ভেলায় ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে
এবার বাঁশ ও কাঠের তৈরি ভেলায় চেপে বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকরা।
বৃহস্পতিবার ভেলায় ভেসে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ প্রবেশ করেছে ১৩২ জন রোহিঙ্গা। দুটি ভেলায় চড়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬১ জন শিশু, ৪০ জন নারী ও ৩১ জন পুরুষ।
এর আগে বুধবার সকালে প্রথম দফায় ভেলায় ভেসে শাহপরীর দ্বীপে ঢোকে ৫২ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে গত দুদিনে ভেলায় ভেসে তিন দফায় বাংলাদেশে ঢুকেছে ১৮৪ রোহিঙ্গা।
বুধবার সকাল ১০ টার দিকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রথম ভেলাটি শাহপরীর দ্বীপ জেটি সংলগ্ন বিজিবি ক্যাম্পের সামনে পৌঁছে। এতে নারী শিশুসহ ৬০ জন রোহিঙ্গা ছিল। এর আধা ঘন্টা পর রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় ভেলাটি শাহপরীর দ্বীপ দক্ষিণ জালিয়াপাড়া পয়েন্টে পৌঁছে। এতে নারী শিশুসহ ৭২ জন রোহিঙ্গা ছিল ।
ভেলায় চড়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তারা সবাই রাখাইনের বুসিডং, রাসিডং ও সিন্দিপ্রাং এলাকার বাসিন্দা। রাখাইনে সেনাদের চাপের মুখে ঘরে বন্দি জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার উদ্দেশ্যে কেউ এক সপ্তাহ আগে আবার কেউ দু’তিন সপ্তাহ আগেই ঘর ছেড়ে দক্ষিণ রাখাইনের ধাওনখালী চরে এসে অবস্থান করছিল। কিন্তু সেখানে এসে বাংলাদেশ ঢুকতে কোনো নৌকা না পাওয়ায় তারা হতাশ হয়ে কয়েক দফায় তাদের মধ্যে কিছু যুবক জারিকেন বুকে নাফ নদ সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল। কিন্তু খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে দুর্বিষহ দিন কাটছিল নারী ও শিশুদের। তাই তারা রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের এপারে পৌঁছাতেই প্লাস্টিক জারিকেনের উপর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করেছিল ভেলা। সেই ভেলায় ভেসে তারা এখন নিরাপদ জীবনের খোঁজে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
ধাওনখালী চরে আরো অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছে বলেও জানিয়েছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। ওই চরে তাঁরা চরম অনিশ্চিয়তার মধ্যে মানবেতর দিন পার করছে। তাদের অনেকের খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ায় অনাহারে অর্ধাহারে রয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করাই তাদের কাছে একমাত্র সমাধান।
ভেলায় চড়ে আসা রাসিডং এলাকার রোহিঙ্গা নুর হোসেন বলেন, ‘রাখাইনের আমাদের খুব দুর্বিষহ দিন কাটছিল। সেখানকার সেনা ও মগদের চাপের মুখে ঘরে বন্দি জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশ আসতে ১৭ দিন আগেই ঘর ছেড়ে রাখাইনের ধাওনখালী চরে এসে অবস্থান নিই। কিন্তু সেখানে এসে বাংলাদেশ ঢুকতে নৌকা না পেয়ে আমরা হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম।’
বাংলাদেশে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন বলেও জানান এই রোহিঙ্গা।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী হাসিনা খাতুন বলেন, ‘ রাখাইনে সেনা ও মগদের কারণে কেউ কিছুই করতে পারছে না। আমাদের যা ছিল সব হারিয়েছি। ওরা আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই বাংলাদেশে ঢুকতে দুই সপ্তাহ আগে ধাওনখালী চরে এসেছিলাম। কিন্ত আামদের হাতে কোনো টাকা পয়সা না থাকায় অতিরিক্ত ভাড়ায় নৌকায় আসা হয়নি। গ্রামের পুরুষদের হাতে পায়ে ধরে কোনোমতে তাদের ভেলায় (ভ্যুর) চেপে চলে এলাম।’
আরেক রোহিঙ্গা যুবক আবু বকর বলেন, ‘মিয়ানমার সেনারা আমাদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। ক্ষেতের ধান কাটতে বাধা দিচ্ছে। এ ছাড়া তারা আমাদের বাজারে যাওয়া ও স্বাভাবিক চলাচলেও বাধা দিচ্ছে। আমাদের মধ্যে থেকে অনেক যুবক ভাইদের কাজের বাহানা নিয়ে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলেছে, আমরা আমাদের ভাইদের আর খোঁজ পাইনি। আমরা সেখানে থাকলে আমাদেরও একই পরিণতি হতো। তাই অসহায় ও নিরুপায় হয়ে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি।’
ভেলায় চেপে নাফ নদ পাড়ি দেওয়া রোহিঙ্গা নারী আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অন্য সবার চেয়ে আমাদের মতো অসুস্থ নারী ও শিশুদের খুব কষ্ট হচ্ছে সেখানে। সেনা ও মগরা আমাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছিল। যুবকরা ভয়ে আগেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল। ওখানে আমাদের বসবাস করা খুব কঠিন ছিল। তাই সেনা ও মগদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে ১২ দিন ধাওনখালী চরে অপেক্ষার পর অবশেষে ভেলায় ওঠে বাংলাদেশে এসেছি।’
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে রাখাইন থেকে এপারে পালিয়ে আসতে সহসা কোনো নৌকা পাচ্ছে না রোহিঙ্গারা। তবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতেই ইতিমধ্যে ঘর ছেড়ে নাইক্ষ্যংদিয়া ও ঢংখালী সীমান্তে জড়ো হয়ে মানবেতর দিন কাটছে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গার। এদের মধ্যে সবচেয়ে করুন ও দুর্বিষহ দিন কাটছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের।
এদিকে নৌকা না পেয়ে গত ১১ অক্টোবর থেকে ৭ দফায় নাফ নদ সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল ৬১ রোহিঙ্গা। ঝুঁকির সেই যাত্রায় নারী ও শিশুরা বাদ পড়াতেই এবার নতুন কৌশলে ভেলা বানিয়ে নারী ও শিশুসহ নাফ নদী পাড়ির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গারা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন