বাংলাদেশিদের সরিয়ে রোহিঙ্গাদের ‘দখলে’ মধুরছড়া

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে আইওএম অফিসের সামনের রাস্তার শেষ প্রান্তে মধুরছড়া পাহাড়। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাজার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এখন শরণার্থী ক্যাম্পের বিস্তৃতি। এই এলাকার মধ্যেই মধুরছড়া পড়েছে। এক সময় যে এলাকাটি সবুজ বনভূমি ছিল, এখন সেটি উজাড় হয়ে লাখো মানুষের বসতি। যতদূর চোখ যায় শুধুই রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ঘর। তাদের মাঝে বাংলাদেশিদের কোনও ঘর খুঁজে পাওয়া দায়। স্থানীয় বাংলাদেশিদের অবস্থা এখন নিজ ঘরে পরবাসীর মতো।

নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার যে দুই হাজার একর জমি নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার মধ্যে মধুরছড়ার পাহাড়ও রয়েছে। অনেক আগে থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা (বাংলাদেশি) সরকারি বনভূমি দখল করে বসতি গড়ে তুলেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বসতির জন্য এখন প্রায় হারিয়েই গেছে তারা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ লাখো মানুষের বসতি গড়ে উঠায় স্থানীয়দের দুঃখ ও আফসোসের শেষ নেই। কারণ বন বিভাগের জমি হলেও যুগ যুগ ধরেই তাদের দখলে ছিল এই পাহাড়ি এলাকা। প্রতিনিয়ত বন্য প্রাণী আর প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করেই তারা এতদিন সেখানে বসবাস করেছেন, অনাবাদী জমি চাষের যোগ্য করেছেন। যে জমিতে চাষ করে একসময় তারা ফসল ফলাতেন এখন সেই জমিতে লাখো রোহিঙ্গা এসে উঠেছে। ফলে কিভাবে তারা আগামীতে চলবেন তা নিয়েও চিন্তায় আছেন পুরনো বাসিন্দারা।

মধুরছড়ায় প্রায় দুই যুগ ধরে আছেন জাফর আলম। পাঁচ মেয়ে, দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। জাফর আলম আফসোস করে বলেন, ‘এই মধুরছড়া আবাদ করে গোলা ভরে যেত ধানে। গোয়াল ভরা গরু ও মহিষ ছিল। রোহিঙ্গাদের বসতি সব কেড়ে নিয়েছে। আমার পাঁচ একর জমি ছিল। এখন সবখানে রোহিঙ্গাদের বসতি। এই বসতিই আমার সব কেড়ে নিয়েছে।’

রহিমা খাতুন নামের এক নারী জানান, স্বামী গোরা মিয়ার মৃত্যুর পর উখিয়া সদরের হাজীপাড়া গ্রাম থেকে এসে বসতি গড়ে তোলেন মধুরছড়ায়। স্থানীয় এক চাকমা হেডম্যানের কাছ থেকে পাঁচ বছর আগেই দুই একর জমি কিনে বসতি গড়েন। প্রতিনিয়ত বন্য হাতির আক্রমণ সহ্য করে এক ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন একটি মাটির ঘরে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ‘এই মধুরছড়াই আমাকে জীবন দিয়েছিল। এখন সেই জীবন কেড়ে নিয়েছে। সরকার নির্ধারিত যে দুই হাজার একর রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমার বাড়ি ও চাষের জমিও পড়েছে। সরকারি জমি হওয়ায় এর কোনও ক্ষতিপূরণও পাবো না।’

সৈয়দুল করিম নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এসে শুধু বসতি নয়, গাছ গাছালি কেটে সাবাড় করে ফেলেছে। পাহাড়ের মাটি কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মূল ও শেকড় তুলে ফেলেছে। একের পর এক পাহাড় কেটে ন্যাড়া করছে। তাদের কাছে বনবিভাগও যেন অসহায়।’

জাফর, রহিমা ও ছৈয়দুল করিমের মতো জমি হারিয়েছেন মধুরছড়া গ্রামের প্রায় এক হাজার ২০০ পরিবার। এই জমিতেই ফসল ফলিয়ে দিন চলতো তাদের। এখন তারা অসহায়। আগামী দিনগুলো না খেয়ে মরতে হবে এই আশঙ্কায় আছেন তারা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গারা প্রতিদিন দেশি-বিদেশি ত্রাণ পাচ্ছে, পাচ্ছে নানা সুবিধা। কিন্তু, স্থানীয়রা কী করবেন? তারা কিভাবে বেঁচে থাকবেন।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলী কবির বলেন, ‘বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের এই বনভূমির মধ্যে এখন ১০ হাজার একর জমি রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে কুতুপালং রেজিস্ট্রার ক্যাম্পসহ পুরনো রোহিঙ্গা দখলে নিয়েছিল প্রায় ছয় হাজার একর। আর এখন নতুন করে রোহিঙ্গারা এসে দখলে নিয়েছে চার হাজার একর জমি। তবে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যে দুই হাজার একর জমি নির্ধারণ করেছে সেসব জমিগুলো দখলে নেওয়া এই জমির ভেতর পড়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন প্রতিদিনই নতুন নতুন পাহাড়ি জমি দখল করে ইচ্ছেমতো বস্তি তৈরি করছে রোহিঙ্গারা। অনেকেই ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করছে। অবশ্য কিছু কিছু রোহিঙ্গা বস্তি আমরা এরইমধ্যে উচ্ছেদ করেছি। পরবর্তীতে সরকার নির্ধারিত শুধু দুই হাজার একর ছাড়া সব জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে সব রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় নিয়ে আসা হবে।’ এ বিষয়ে কথা বলতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খালেদ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।প্রতিবেদন বাংলাট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।