বাংলাদেশে নির্বাচনী ইশতাহারের বাস্তবায়ন কতটা হয়?


বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে ইশতাহার ঘোষণা করা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে৷ এসব ইশতাহারে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, দারিদ্র্য বিমোচনসহ নানা প্রতিশ্রুতি থাকে৷ কিন্তু যে দল ক্ষমতায়, তারা এর বাস্তবায়ন কতটুকু করে?


৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ইশতাহার তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে৷ আওয়ামী লীগ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা এবং রূপকল্প ২০৪১-কে প্রাধান্য দেবে বলে জানা গেছে৷ আর বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দেবে৷

ইশতাহার তৈরিতে দু’টি দলেরই উপ কমিটি কাজ করছে৷ বিএনপি’র উপ কমিটির সদস্যরা প্রার্থীদের মনোনয়ন সাক্ষাৎকারের সময় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিএনপির ইশতাহারে দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকবে৷

আর আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্যরা এরইমধ্যে প্রাথমিক ইশতাহার তৈরি করে আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েছেন৷ আর তাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ, কর্মসংস্থান, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আর তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো বেশ কিছু বিষয় থাকছে৷

এবার এই প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলই তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চায়৷ কারণ, গত ১০ বছরে তরুণ ভোটার বেড়েছে দুই কোটির ২৫ লাখেরও বেশি৷ তাঁদের অধিকাংশের বয়স এখন ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে৷ আর এবার মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন৷

ইশতাহার বিশ্লেষণ

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তাদের ইশতাহারে দিন বদলের কথা বলেছিল৷ আর ২০১৪ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ৷ তবে ২০০৮ সালের ইশতাহারে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছিল৷ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচার শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত আছে৷ ২০১৪ সালের ইশতাহারে এই বিচার চলমান রাখার কথা বলা হয়৷ আওয়ামী লীগ তার ইশতাহারে দেয়া এই প্রতিশ্রুতি পালন করেছে৷ আর ২০০৮ সালের ইশতাহারে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছিল৷

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ‘রূপকল্প-২০২১’ শিরোনামে ইশতাহার করে আওয়ামী লীগ৷ সেই ইশতাহারেও প্রতিবছর মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশের কথা বলা হয়েছিল৷

‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই ইশতাহারে সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ২৬ দফার অগ্রাধিকার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও শাস্তি কার্যকর এবং বিচার বানচাল করতে আন্দোলনের নামে হত্যা, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বৃক্ষ নিধনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের অঙ্গীকার করা হয়৷

সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূল, সব ধর্মের শন্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও প্রচার নিষিদ্ধ করার অঙ্গীকার করা হয়৷ কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না বলে ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়৷ইশতাহারে পাঁচ বছরের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত এবং দারিদ্র্যের অনুপাত ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়৷ দ্বিতীয় পদ্মা সেতু ও দ্বিতীয় যমুনা সেতু নির্মাণের কারিগরি ও অন্যান্য প্রস্তুতি শেষ করে পাঁচ বছরের মধ্যে এ দুটি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করার ঘোষণাও দেয়া হয়৷

বিএনপি সর্বশেষ নির্বাচনি ইশতাহার দেয় ২০০৮ সালে৷ কারণ, ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি৷ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০টি আসন পাওয়ায় বিরোধী দলে অবস্থান নেয়৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে বিএনপি সর্বশেষ ক্ষমতায় গিয়েছিল৷

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দেয়া ইশতাহারের শিরোনাম ছিল ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’৷ তারা ৩৪ দফা ইশতাহারে অর্থনেতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ছাড়াও কার্যকর সংসদ, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, রাষ্ট্র ও সামাজিক সকল শক্তির মধ্যে কার্যকর সমঝোতা, সক্ষম ও নিরপেক্ষ প্রশাসন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি এবং গণমুখী প্রশানের কথা বলে৷ এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের আরো অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়৷ ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেও ইশতাহারে বিএনপি একইরকম প্রতিশ্রুতি দেয়৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের কথাও বলে তারা৷

ইশতাহার বিশ্লেষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিদ্যুৎখাতে উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা অনেকটাই পুরণ করেছে৷ তবে সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, কর্মসংস্থান, গণতন্ত্রায়ন এসব ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি৷ বরং উল্টোও ঘটেছে কোথাও কোথাও৷ বিশেষ করে পরপর দুইবার ইশতাহারে তারা মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আয়ের হিসাব প্রকাশের কথা বললেও তা কখনোই করেনি৷ মাথাপিু আয় বাড়লেও আয়বৈষম্য বেড়েছে৷

বিএনপিও ক্ষমতায় থাকাকালে তার নির্বাচনি ইশতাহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি৷ সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি৷ গণতন্ত্রায়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, ক্ষমতার ভারসাম্য এসব ক্ষেত্রে তাদের কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবের মুখ দেখেনি৷ উল্টো তাদের সময় দুর্নীত ও অর্থ পাচার বেড়েছে৷

কথার ফুলঝুড়ি

রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতাহারে কথার ফলঝুড়িই বেশি দেখা যায়৷ ব্যাতিক্রম ছাড়া আগের ইশতাহারের ধারাবাহিকতা থাকে না৷ আর নতুন ইশতাহারে আগের ইশতাহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবি করা হয়৷ কিন্তু থাকে না আগের ইশতাহারের সঙ্গে নতুন ইশতাহারের তুলনা৷ আওয়ামী লীগের ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের ইশতাহারে বেশ ধারাবাহিকতা থাকলেও বাস্তবায়নের বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য নেই৷ নেই গ্রহণযেগ্য হিসাব৷ আর কেন বাস্তবায়ন হয়নি তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ আর বিএনপি’র ইশতাহারে ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না৷ তবে প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতা আছে৷ প্রতি ইশতাহারেই প্রায় একই কথা বলা হয়৷

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতাহারে বলা হয়েছিল, মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হবে৷ কিন্তু করা হয়নি৷ কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট পরিহারের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু তা পরিহার করা হয়নি৷ মন্ত্রী শাজাহান খানই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বড় উদাহরন৷ এটা শুধু আওয়মী লীগের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, তা নয়৷ অন্য দলের ক্ষেত্রেও ঘটেছে৷ যারা পাওয়ারে গেছেন, তারা ইশতাহারকে মাথায় রেখে কাজ করেননি৷ আমার কাছে মনে হয়েছে, ইশতাহার একটা ভাওতাবাজী৷”

তিনি বলেন, ‘‘সব দলের ইশতাহারেই গণতন্ত্র, সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন, দারিদ্র্য বিমোচন, সম্পদের সুসম বণ্টন এরকম আরো অনেক কথা থাকে৷ আর এগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে তো গণতন্ত্রের সংকট থাকত না৷ সুশাসনের অভাব হতো না৷ দেশ হতো দুর্নীতিমুক্ত৷ বিচার বিভাগ থাকতো স্বাধীন৷ কিন্তু বাস্তকে কি তা হয়েছে?”

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ)-এর চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলো ইশতাহারকে এক ধরনের রিচ্যুয়ালের মতো করে নিয়েছে৷ আর এতে দেশের সাধারণ মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ নেই৷ কিছু শহুরে মানুষ এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে৷ তাই রাজনৈতিক দলগুলোও এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না৷ প্রকাশ করতে হয়, তাই করে৷”

ইশতাহারকে জবাবদিহিতায় আনতে হবে

ইশতাহার তৈরিতে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো জরিপ বা জনগনের মতামত নেয় বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না৷ তারা তাদের মতো করে একটি ইশতাহার তৈরি করে, যাতে জনগণের কোনো মতামত বা অংশগ্রহণ থাকে না৷ ড. কলিমুল্লাহর মতে, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এই ইশতাহার তৈরির আগে তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে জনগণের মতামত নেয়া, সেই মতামত থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বের করা আসলে দেশের মানুষ কী চায় এবং তার ভিত্তিতে সক্ষমতা বিবেচনা করে ইাতেহার তৈরি করা৷”

হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘‘এছাড়া বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ সারাবছর বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত দেয়, সুপারিশ করে৷ সেগুলোও ইশতাহার তৈরির সময় বিবেচনায় রাখা উচিত৷”

আর ইশতাহার বাস্তবায়ন হলো কিনা, তা নিয়ে জবাবদিহি করতে হয় না, যারা ক্ষমতায় যান তাদের৷ এ ধরনের জবাবদিহিতার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই৷ ড. কলিমুল্লাহ বলেন, ‘‘ক্ষমতায় যারা যায়, তাদের তা বাস্তবায়নে সংসদে একটা চাপ সৃষ্টি করা যায়৷ কিন্তু সংসদ তো কার্যকর নয়৷ বিরোধী দল নেই৷ আর সরকারী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে ভূমিকা রাখেন না৷”

হাফিজউদ্দিন খানও মনে করেন, ‘‘ইশতাহারের প্রতি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সৎ থাকা উচিত৷ জনগণের কাছে জবাবাদিহতার ব্যবস্থা থাকা উচিত৷ তার একটি জায়গা হতে পারে সত্যিকার অর্থে কার্যকর সংসদ৷”

ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘‘এই ইশতাহারের ওপর ক্ষমতায় যাওয়া নির্ভর করে না৷ ভোটাররা এটা দেখে ভোটও দেয় না৷ কিন্তু ভোটাররা যদি ইশতাহারের ব্যাপারের ক্রিটিক্যাল হতো, তারা যদি এটা নিয়ে কথা বলত, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোও সতর্ক হতো৷”-ডয়চে ভেলে