বাংলাদেশ রেলওয়ে যুক্ত হচ্ছে নতুন নেটওয়ার্কে
যুগোপযোগী নানা পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরই মধ্যে বেশকিছু নতুন লাইন, ইঞ্জিন ও কোচ যুক্ত হয়েছে রেল বহরে। গত এক যুগে (২০০৯ থেকে বর্তমান) ৪৩টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। দৃশ্যমান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন চালু হচ্ছে আগামী বছর।
এ লাইনটি যুক্ত হবে মিয়ানমার, ভারত, নেপাল ভুটানসহ ২৭টি দেশের সঙ্গে। এছাড়া দশ বছর পর আবার নতুন করে চালু হচ্ছে সিরাজগঞ্জ রেললাইন প্রকল্প।
এদিকে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, মেহেরপুর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বান্দরবান, কক্সবাজার, নড়াইল, মানিকগঞ্জ, পিরোজপুর, বাগেরহাটসহ ১৬টি জেলাকে রেলওয়ের নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের কোনো জেলা রেলওয়ের নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবে না। পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলাকে এই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে।
মানিকগঞ্জবাসীর আন্দোলন ও দাবির মুখে অবশেষে মানিকগঞ্জকেও রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গাজীপুরের টঙ্গী থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে পাটুরিয়া পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করবে রেলওয়ের কর্তৃপক্ষ।
ইতোমধ্যে ৪৮ কোটি ৯ লাখ টাকার একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য গত মাসে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের পর কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মানিকগঞ্জ জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হবে। সবমিলিয়ে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বেড়ে যাবে বলে স্থানীয়রা জানান।
তারা জানান, রেললাইনটি তৈরি হয়ে গেলে বিশেষ করে মানিকগঞ্জ ও এর পার্শ্ববর্তী স্থানগুলোর মতো জায়গায় মানুষ বসবাসে উৎসাহিত হবে। তারা দৈনন্দিন কাজের জন্য দ্রুত ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া করতে পারবে, যা শেষ পর্যন্ত রাজধানীর ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমাবে।
এ ছাড়া যারা ঢাকা এবং উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত করবে, তারা একটি নতুন রুট পাবে, যা যাতায়াতের সময় কমিয়ে আনবে। তবে এসবের জন্য বেশ কিছুটা সময় লাগবে। পরিকল্পনা কমিশন যদি প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়, তবে রেলওয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই পরিচালনা ও নকশাটি তৈরি করার জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেবে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, যাচাই শেষে প্রকল্পটি কার্যকর উপযোগী বলে মনে করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ে তহবিল প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে এটি নির্মাণের জন্য অন্য একটি প্রকল্প নেবে।
তবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে পদ্মা নদীর ওপর দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি কার্যকর দ্রুততা বৃদ্ধি পাবে না বলে রেল বিশেষজ্ঞরা জানান। দীর্ঘদিন ধরেই দৌলতদিয়া রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের মধ্যে দূরত্ব কমাতে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কুমিল্লা রুটে রেলপথ নির্মাণের জন্য রেলওয়ের কাজ করা উচিত বলে তারা মনে করেন।
তবে রেলওয়ের অন্য কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু সরকার নিশ্চিতভাবেই দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করতে যাচ্ছে, তাই তারা আগে থেকেই ঢাকা-পাটুরিয়া রেলপথের পরিকল্পনা করতে চান। যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কয়েক বছর পর পদ্মা রেল-সংযোগ প্রকল্প নেওয়া হয়। সে কারণে তারা একইসঙ্গে সেতুতে সড়ক ও রেল উভয় কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না।
ঢাকা-মানিকগঞ্জ লাইন ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ শহর হয়ে পাটুরিয়া পর্যন্ত রেল লাইনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন মানিকগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ে প্রায় ৩ বছর আগে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠকও করেছিল।
তারা আরও জানান, আলোচনার পর এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল এবং উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্বিবেচনা করতে বলা হয়েছিল। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ও ডিপিপি নতুন করে সাজানোর পর রেল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গত মাসে সেগুলো পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
প্রস্তাব অনুযায়ী, সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা ও টেন্ডার ডকুমেন্টের পরামর্শ সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। আর প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, শো ডকুমেন্টসসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হবে প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে পাটুরিয়া পর্যন্ত রেল সংযোগ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করবেন নিয়োগ পাওয়া পরামর্শক। টঙ্গী থেকে কেন ট্র্যাকটি নির্মাণ করা হবে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর মধ্য দিয়ে সরাসরি লাইন দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই টঙ্গী নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরামর্শক সব কার্যকর বিকল্পগুলো পরীক্ষা করবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ঢাকা-মানিকগঞ্জ রেলপথ তৈরির বিষয়টি বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে আছে। পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেলেই কাজের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে তিনি জানান।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের আরো ৬টি জেলা রেলওয়ের নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। জেলাগুলো হলো- শেরপুর, ঝালকাঠি, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, পটুয়াখালী ও বরগুনা।
রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, রেলকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বর্তমান সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আলাদা মন্ত্রণালয় করে দিয়েছেন। রেল খাতে অধিক বরাদ্দ দিচ্ছেন ।
নতুন নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, সারা দেশকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নতুন লাইন চালু হলে কী সুবিধা হবে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেছেন, এ লাইন চালু হলে পর্যটকদের আগমন সহজ হবে। এর মাধ্যমে দেশি বিদেশি পর্যটক অধিকহারে কক্সবাজার আসা-যাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা থেকে সরাসরি ট্যুরিস্ট ট্রেন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
রেলসূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের যানজট নিরসনে চীন থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০ সেট (৩ ইউনিটে একসেট) ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিইএমইউ) সংগ্রহ করা হয়েছে।
সংগৃহীত ডিইএমইউ দ্বারা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে ১৬ জোড়া কমিউটার ট্রেন এবং জয়দেবপুর-ঢাকা সেকশনে ৪ জোড়া কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়েছে।
এছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-জয়দেবপুর, ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর, আখাউড়া-কুমিল্লা, লাকসাম-কুমিল্লা-চাঁদপুর, লাকসাম-কুমিল্লা-নোয়াখালী, সিলেট-আখাউড়া, পার্বতীপুর-ঠাকুরগাঁও, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাাম শহরে সার্কুলার কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এতে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জনবহুল শহরগুলোতে যানজট অনেকাংশে লাঘব হয়েছে বলে রেল কর্তৃপক্ষ জানায়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন