বাংলা-বাঙালির অহংকার : রক্তস্নাত একুশে ফেব্রুয়ারী

বাংলা-বাঙালির অহংকার : রক্তস্নাত একুশে ফেব্রুয়ারী

প্রফেসর মো. আবু নসর

শহীদদের রক্তস্নাত আর গৌরবগাঁথার অনন্য স্মৃতির দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিতে আবার এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারী। ২১ ফেব্রæয়ারী শহীদ দিবস কারো দানে নয়, বরং প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ফসল। ৫২’র ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনার মহাকাব্য। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বায়ান্নয় রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো বীর বাঙালি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক অবদান সর্বজনবিদিত। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রাচীন। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে ভাষার জন্ম আজ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসর পূর্বে। ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতির জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা যা বাঙ্গালী কখনও ভুলতে পারে না। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন ঘটেনি। ভাষা আন্দোলন ছিল লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তান আন্দোলনেরই বর্ধিতরূপ। ইতিহাসের পিছনে যেমন ইতিহাস থাকে, তেমনি বায়ান্নর পিছনেও ছিল আটচল্লিশ। ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ সংঘটিত হয় বাংলা ভাষার দাবীতে প্রথম সফল গণবিষ্ফোরণ। শুধু ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ নয়, আমরা দেখেছি ১৯৪৭ সালেও রয়েছে ভাষা আন্দোলনের এক গৌরবময় সূচনা-পর্ব। বায়ান্নর গোড়ায় যেমন ছিল আটচল্লিশ, তেমনি আটচল্লিশের গোড়ায় ছিল সাতচল্লিশ। বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিল ১৯৪৭ এর ১৪ আগষ্টে ভারতবর্ষ ভাগাভাগির (পার্টিশন) মাধ্যমেই। সে হিসেবে বলা যায় ১৪ আগষ্টের পূর্বে যেমন রচিত হয় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত-পর্ব, তেমনি ১৯৪৭ সাল ছিল এ আন্দোলনের সূচনা-পর্ব। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সফল বিষ্ফোরণ-পর্ব এবং বায়ান্নর একুশ ফেব্রæয়ারী ছিল চূড়ান্ত বিষ্ফোরণ-পর্ব। এর কোন একটাকে অন্যটা থেকে বিচ্ছিন করে দেখার উপায় নেই। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই আমাদের স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধিকার চেতনা তথা স্বাধীনতা আন্দোলন তরান্বিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও সূত্র অন্বেষন করতে গেলে সবার আগে মনে আসে বহু ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কথা। এর পরেই আসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর আবুল কাশেম ও তমুদ্দুন মজলিসের ঐতিহাসিক ভূমিকা।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম ভাষা আন্দোলনের কারণে কারাবরণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ ভাষা সৈনিকরা। অন্যান্য ভাষা সৈনিকদের মধ্যে তমুদ্দুন মজলিসের আবুল কাশেম, অলি আহমদ, আব্দুল মতিন, গাজিউল হক, মো.তোয়াহা, নুরুল হক ভূইয়া, এডভোকেট ফজলুর রহমান, বদর উদ্দীন ওমর, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, কমর উদ্দীন আহমেদ, বশির আল হেলাল, এমআর মাহবুব, শেখ আমানুল্লাহ, ভাষা বিজ্ঞানী ড.এসএম লুৎফর রহমান, ভাষা আন্দোলন গবেষক মোহাম্মদ আমীন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিদেশিদের মধ্যে প্রথম মত দেন ব্রিটিশ লেখক ন্যাথনিয়েল ব্রাসি হলহেড। ১৭৭৮ সালে তিনি তাঁর বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ ‘এ গ্রামার অব দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটিতে ওই অভিমত প্রকাশ করেন।
সর্বপ্রথম শহীদ মিনার তৈরি হয়েছিলো ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারী রাতারাতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে যেখানে ভাষার জন্য বাঙালির প্রথম রক্ত ঝড়েছিলো। সাড়ে ১০ফুট লম্বা সেই প্রতীকটির প্রথম নাম ছিলো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। সেটি জনৈক পিয়ারু সরদারের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিলো।

২১ ফেব্রæয়ারী ও মাতৃভাষা ভাষা আন্দোলনের উপর বিভিন্ন গীতিকার এবং কবিদের গান ও কবিতার মধ্যে আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারী, আমি কী ভুলিতে পারি..’, চারণ কবি শেখ শামসুদ্দিন রচিত ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি, ঢাকা শহরের রাজপথ রক্তে ভাসাইলি..’, আব্দুল লতিফের বিখ্যাত গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়..’, প্রতুল মুখোপধ্যায়ের কথা ও সুরে দক্ষিন কোরিয়ার শিল্পী মিংজুর কন্ঠে ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই, আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই..’, কবি ফররুখ আহমদের কবিতা ‘আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান, বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার রূপ যে অনির্বাণ..’, মাহবুব আলী চৌধুরী রচিত একুশের ঐতিহাসিক কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি..’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য চারণ কবিদের মধ্যে আব্দুল হাকিম, মোশারফ উদ্দীন, রমেশ শিল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ নাম স্মরণযোগ্য।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে প্রথম স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৫৩ সালের মার্চে। এর প্রকাশক ছিলেন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি মো.সুলতান ও সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ওই গ্রন্থে কবির উদ্দীন আহমদ ‘একুশের ঘটনাপঞ্জি’ নামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লেখেন- ‘১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারী পর্যন্ত সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।’ তৎকালীন পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খাঁন তার ‘পাকিস্তানস আদার স্টোরি : দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভল্যুশন’ বইয়ে লিখেছেন- পুলিশের গুলিতে ২৬ জন শহীদ ও চারশত জনের মতো আহত হয়েছিলেন।

একুশে ফেব্রæয়ারী জাতীয় জীবনে চিরভাস্বর একটি দিন। একুশ আমাদের শাশ্বত প্রাণের স্পন্দন। একুশ আমাদের বাতিঘর। ১৯৫২ সালের রক্তঝরা একুশে ফেব্রæয়ারী আমাদের জাতিসত্তার চাবিকাঠি। ১৯৪৭ পরবর্তী জাতীয় জীবনে সব গণজাগরণ, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনার মূলে জড়িয়ে আছে ফেব্রæয়ারী স্মৃতি। ৫২’ এর ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালি জাতির সংগ্রামী চেতনার মহাকাব্য। এটি কোন সাধারণ সন তারিখ নয়। এটি শোক, প্রেরণা, শপথ আর অঙ্গীকারের মিলিত স্রোতধারা। ২১ এর পথ ধরেই বাঙ্গালী হেটেছিল স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার দিকে। পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে একমাত্র বাংলাদেশের মানুষ। ২১ ফেব্রæয়ারী একই সাথে শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি আজ নিজের দেশের সীমানার গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সম্প্রসারিত হয়েছে। আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয় একুশে ফেব্রæয়ারী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারী বৃহষ্পতিবার বেলা ৩টার দিকে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন রফিক উদ্দীন। পরে আরো শহীদ হন শফিক, সালাম, বরকত জব্বার, রিকসা চালক আউয়াল, কিশোর অলিউল্লাহ, সিরাজ উদ্দীন প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, মাতৃভাষা রক্ষা আন্দোলনে খুলনা থেকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ নেতৃত্ব দিয়ে বন্দি হওয়ার পর ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর খাপরা ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সাতক্ষীরার বুধহাটার সন্তান ছাত্র নেতা আনোয়ার হোসেন। তারা অনেকেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের বীর। তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে ভাষা আন্দোলন সহ স্বাধীকার , অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দেদীপ্যমান।

২১ ফেব্রæয়ারীর ইতিহাস ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এ ইতিহাসের নায়ক কিম্বা মহানায়ক তারাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের জীবনে দিগন্তবিস্তারী প্লাবন ডেকে এনেছিল। বাংলা ভাষাকে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও নির্মমতার আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য এক দেবদূত হিসেবে এসেছিল অমর একুশে। তাই ভাষার দাবী অর্থাৎ বাঁচার দাবী, ভাষার আন্দোলন অর্থাৎ বাঁচার আন্দোলন। ২১ ফেব্রæয়ারী আমাদের চেতনার প্রথম সূর্যসিড়ি। ২১ ফেব্রæয়ারী কেবল ভাষার লড়াই নয়, তা আমাদের জাতীয় চেতনার উর্বর উৎব। বাঙ্গালী জাতির জীবনে তাই ভাষা আন্দোলন দুর্জয় সংগ্রামী চেতনার প্রসুতি। একুশ মানে নিজেকে চেনা। একুশের চেতনার মূল জায়গায় শুধুমাত্র ভাষার দাবী ছিল না। এ দাবী ছিল গণতান্ত্রিক দাবী। আর এ গণতান্ত্রিক দাবীর ধারাবাহিকতাতেই আন্দোলন হয়েছে, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, একটা নতুন রাষ্ট্র হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান তাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। রক্তের পথ বেয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার বীজ বোনা হয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।

ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণফসল হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাঙালির আরেক বিজয়। ২১ ফেব্রæয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পিছনেও রয়েছে দীর্ঘ সাধনা ও সংগ্রামের ইতিহাস। ‘‘The Mother Language Lover of the world’’ নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কানাডা প্রবাসী বাঙ্গালি জনাব রফিকুল ইসলাম ও জনাব আব্দুস সালাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রæয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আবেদন জানান। এই আবেদনে ফিলিপিনো, ইংরেজি, ক্যান্ডনিজ, মালয়, জার্মান, হিন্দি এবং বাংলা ভাষী অর্থাৎ সাত জাতি ও সাত ভাষার ১০জন স্বাক্ষর করেন। এর এক বছর পর ইউনেস্কো সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ রফিকুল ইসলামকে সম্মতিসূচক চিঠি লেখেন। Regarding your request to declare the 21 February as International mother language day, the idea is indeed very interesting. অবশেষে Bangladesh National Commission for UNESCO’র পক্ষে সচিব প্রফেসর কফিল উদ্দীন আহমদ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। ইউনেস্কোর ১৫৭তম অধিবেশন ও ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে বাংলাদেশের এই প্রস্তাব যাওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয়। অবশেষে ইউনেস্কোর ১৬০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে মতামত গড়ে তোলেন। ১৮৮টি দেশ ২১ ফেব্রæয়ারী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনে সম্মত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) তার প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রæয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষনা করে। ১৬০ তম ওই অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ ঘোষনায় বিশ্বের প্রায় ৮হাজার মাতৃভাষা সম্মানিত হলো। প্রতি বছর ২১ ফেব্রæয়ারী ইউনেস্কোর সদর দপ্তর সহ পৃথিবীর ১৯৪টি সদস্য দেশে নিজ নিজ মাতৃভাষার আলোকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তাই বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে গৌরবময় ও অবিস্মরণীয় দিন।

রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষা এক নয়। মাতৃভাষা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই মানুষ অর্জন করে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা শিক্ষা দ্বারা, সাধনা দ্বারা, জ্ঞান-গরিমা নিয়ে অর্জন করতে হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে রাষ্ট্রভাষা সক্রিয় থাকে। চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষাকে বিকাশশীল রাখতে হয়। আর মাতৃভাষার চর্চা বাবা, মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও ক্ষুদ্র পরিবেষ্টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও মাতৃভাষা দ্বারা জীবনটাকে বেশি উপভোগ করা যায়। আর মাতৃভাষকে অবলম্বনে করেই রাষ্ট্রভাষা গড়ে ওঠে। ভাষা-ই মাতৃভূমি, ভাষা-ই মা। রাষ্ট্রভাষা কেবল সংবিধানে থাকলে হবে না, রাষ্ট্রীয় জীবনে সম্ভবপর সর্বস্তরে তার প্রকৃষ্ট ও জীবন্ত ব্যবহার থাকা দরকার। রাষ্ট্রভাষা তথা জাতীয় ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োজন জাতীয় ভাষানীতি। অনেকের ধারণা মাতৃভাষা পরিমন্ডলের বাইরে বাংলা ভাষার ব্যবহার স্থায়ী হবে না। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মত’’ মহাত্ম গান্ধী বলেছেন, মাতৃভাষাকে ছোট করা মানে নিজের মাকে ছোট করা। সরোজিনী নাইডু বলেছেন, ‘‘মাতৃভাষা একটি জাতির হৃদয়, একজন মানুষের আত্মা’’। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের বহু ভাষায় পান্ডিত্য থাকা সত্তে¡ও তিনি নিজের মাতৃভাষা বাংলা চর্চা করতেন। তিনি জানতেন মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া ও মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোন ভাষা ভালভাবে শেখা যায় না। মাতৃভাষা মানুষের একান্ত আপন ও কাছের। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার সেরা দান। মানুষ যদি তার মাতৃভাষাকে যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন না করতে পারে তবে তাকে চিরদিন আত্মগøানিতে ডুবে থাকতে হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। যারা মাতৃভাষার মর্যদা দেয় না তারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিশ^াস করে না। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষা মাত্রই সামাজিক। সমাজ পিছনে পড়ে থাকলে ভাষা এগুলো পারে না। তাই সমাজের দরিদ্রতা, বৈষম্য, নিরক্ষরতা দূর করে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে হবে। মাতৃভাষা বাংলা বাঙ্গালির জীবনে খরস্রোতা নদী আর শহীদ মিনার বাঙ্গালীর হিমালয়।

বাংলা ভাষার প্রতি চাই ভালোবাসা। বাংলা বাঙালির হোক, বাঙালির জয় হোক, বাংলার জয় হোক।

 

লেখক:
প্রফেসর মো.আবু নসর,
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ,
কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
মোবা: ০১৭১৭-০৮৪৭৯৩