বাগেরহাটে নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় আহত দেড় শতাধিক

বাগেরহাটে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও মোংলা উপজেলায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে বিজয়ী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।

রোববার নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ৩ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনি সহিংসতায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

তিন উপজেলার মধ্যে সব থেকে বেশি আহত হয়েছে মোরেলগঞ্জ উপজেলায়। এ উপজেলায় বিজয়ী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হামলায় পরাজিত প্রার্থীর শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আহতদের মধ্যে অন্তত ৮ জন মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন। কেউ কেউ শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পিরোজপুর সদর হাসপাতালেও চিকিৎসা নিয়েছেন।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন মোরেলগঞ্জ উপজেলা উত্তর সুতালরি ৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুয়াল হোসেন জোয়াদ্দার (৬৫) বলেন, দোয়াত কলম প্রতীকের কেন্দ্র সমন্বয়ক থাকার কারণে নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে বিজয়ী প্রার্থীর লোকজন রাস্তার ওপর ফেলে আমাকে মারধর করে। বৃদ্ধ বয়সে কখনো আশা করিনি, এমন হামলার শিকার হব। যারা হামলা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাহ জামাল তালুকদার বলেন, বুঝ হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সরকারি দলের দুইজন প্রার্থী ছিলেন, একজনের পক্ষে কাজ করায়, আজ আমি হাসপাতালে। শুধু আমি না, এলাকার অনেক নেতাকর্মীকে এভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আর কেউ যেন নির্যাতনের শিকার না হয় এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

এদিকে বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা থেকে বাঁচতে মোরেলগঞ্জ উপজেলার খাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে আশ্রয় নিয়েছে অর্ধশতাধিক নারী পুরুষ।

পরিষদে আশ্রয় নেওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দোয়াত কলম প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মোজাম্মেল হক মোজামের ভোট কেন্দ্রের এজেন্ট নুপুর আক্তার বলেন, চেয়ারম্যানবাজার ভোট কেন্দ্রে আনারস প্রতীকের এজেন্ট ছিলাম। ভোটে আমাদের প্রার্থী হেরে যান। ভোটের দিন বিকালেই খাউলিয়া এলাকার দেলোয়ার খলিফা ও রানা শিকদার আমাকে হুমকি দেন। পরের দিন সকালে খাউলিয়া বাজারে থাকা আমার বাবার সাইকেল-ভ্যানের গ্যারেজ বন্ধ করে দিয়েছেন। আমাকে মারধর ও রাস্তায় অপমান করবে বলে হুমকি দিয়েছে। এ অবস্থায় মানসম্মান বাঁচাতে ইউনিয়ন পরিষদে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আমরা জীবনের নিরাপত্তা চাই।

খাউলিয়া ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সাবেক ইউপি সদস্য শাহনাজ বেগম বলেন, ভোটের পরে এলাকায় যা ইচ্ছে তাই করছে দেলোয়ার খলিফা ও রানা শিকদার। অনেককে মারধর করেছে। আমার কাছে টাকা চেয়েছে, মারধরেরও হুমকি দিয়েছে। কারও কারও দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকের সঙ্গে আমিও পরিষদে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আওয়ামী লীগ করেও যদি এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব।

দেলোয়ার খলিফা ও রানা শিকদারের লোকজনের মারধরে মাথা ফেটেছে খাউলিয়া ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুণ অর রশীদের। তিনিও বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন খাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে। তিনি বলেন, অপরাধ শুধু দোয়াত কলম প্রতীকের এজেন্ট ছিলাম। এজন্য আমাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিছে। এলাকার অনেকেই এখন বাড়ি ছাড়া। আমরা এই রাজনীতি চাই না।

খাউলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার সাইদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দল থেকে একাধিক প্রার্থী হয়েছেন। কর্মীরা যার যার পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। আমরাও দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছি; কিন্তু আনারস প্রতীকের প্রার্থী বিজয় লাভ করায় তার সমর্থকরা এলাকার লোকজনের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করছে। সম্মান ও প্রাণ বাঁচাতে অনেক লোক ইউনিয়ন পরিষদে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। অতিদ্রুত এ অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানান এই জনপ্রতিনিধি।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শর্মী রায় বলেন, গেল দুই দিনে মারধরে আহত ৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। আমরা তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করেছি।

পরাজিত দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী মোজাম্মেল হক মোজাম বলেন, নির্বাচনের আগে ও পরে আমার কর্মী-সমর্থকদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। দুই দিনে আমার শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হয়েছেন। অনেকের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও লুটপাট করেছে তারা। আমি যদি নির্বাচন করে ভুল করি, তাহলে আমাকে মারধর করুক। তবু আমার কর্মী-সমর্থকদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করুক। চলমান সহিংসতা বন্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই নেতা।

নবনির্বাচিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী খান বলেন, সবাইকে শান্ত থাকতে বলা হয়েছে। কোনো প্রকার বড় সহিংসতার খবর পাইনি। অনেকে আবার ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে এ সময়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। কোথাও যাতে কোনো সমস্যা না হয় এজন্য সবাইকে বলা হচ্ছে।

এদিকে নির্বাচনের পর চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী প্রার্থী রায়হান উদ্দিন আকন শান্তর সমর্থকদের হামলায় পরাজিত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আছাদুজ্জামান মিলনের অন্তত ৩০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তারা শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

অন্যদিকে নির্বাচনের পরে মোংলায়ও বিজয়ী প্রার্থী আবু তাহের হাওলাদারের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে পরাজিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মারধর ও অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে। এ উপজেলায় অন্তত ২৫ জন কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন।

আহতদের মধ্যে উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি পিযুষ কান্তি মজুমদারসহ ৮ জনকে গুরুতর অবস্থায় মোংলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছেন। প্রতিবাদে সোমবার দুপুরে মোংলা পোর্ট পৌরসভার সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে পূজা উদযাপন পরিষদ ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. রাসেলুর রহমান বলেন, নির্বাচনপরবর্তী তিন উপজেলায় কিছু ছোটখাটো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বড় ধরনের সহিংসতা এড়াতে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।