বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, তারেকের যাবজ্জীবন
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। মামলার জীবিত ৪৯ আসামির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন বিচারক। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বুধবার (১০ অক্টোবর) এই রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের সময় ৩১ আসামিকে কারাগারে হাজির করা হয়। বেলা ১২টার দিকে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। মামলার পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
বিচারক আদালত এজলাসে বসেন ১১টা ৪০ মিনিটে। এর পরপরই তিনি রায় পড়া শুরু করেন। বিচারক এজলাসে আসার আগেই ১১টা ২০ মিনিটে আসামিদের কাঠগড়ায় তোলা হয়।
এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মামলার রায়ের দিন ধার্য করা হয়। মামলার ৫২ আসামির মধ্যে তিন জন মারা গেছেন। মামলার আসামি বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি হয়েছে অন্য মামলায়। বাকি আসামিদের মধ্যে ৩১ জন কারাবন্দি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৮ আসামি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের মধ্যে ৯ জন যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। ভারতে কারাবন্দি রয়েছে দুইজন। অন্য সাত আসামির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আর অন্যদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
অভিযোগ গঠনের পর বিচারিক কার্যক্রম শুরুর পর ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এরপর আসামিদের জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। পরে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষে ১১৯ কার্যদিবস যুক্তিতর্কের মাধ্যমে শুনানি করেন। এতে আসামিপক্ষ ৯০ কার্যদিবস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ২৯ কার্যদিবস শুনানি করেছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী ও অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি নিহত হন। তবে ওই হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন তিনি।
হামলার পরদিন ২২ আগস্ট মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ২০১, ১১৮, ১১৯, ২১২, ৩৩০, ২১৮, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় একটি মামলা (নং-৯৭) দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর প্রথমে মতিঝিল থানা পুলিশ ও পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে। গোয়েন্দা পুলিশ কিছুদিন মামলাটির তদন্ত চালানোর পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)-এর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ পর্যায়ক্রমে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তদন্ত শুরুর কয়েকদিন পরই নোয়াখালীর সেনবাগের জজ মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে গ্রেনেড হামলার রহস্য উদঘাটনের দাবি করেন সিআইডি’র কর্মকর্তারা। কিন্তু ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পটপরিবর্তনের পর ২১ আগস্ট হামলা মামলারও চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির এএসপি ফজলুল কবিরকে। ২০০৮ সালের ৯ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে সিএমএম আদালতে দু’টি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন এএসপি ফজলুল কবির। ওই বছরই মামলা দু’টির কার্যক্রম দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১-এ স্থানাস্তর করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের ২৯/১১ (হত্যা) ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পুরনো ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে পিডব্লিউডির একটি পুরনো সরকারি ভবনকে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে ২৯/১১ (হত্যা), ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) নম্বর মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম চলে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গেলে পুরোপুরি পাল্টে যায় এ মামলার তদন্তের ধারা। ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের পর ২০০৯ সালের ২৫ জুন আদালতের কাছে এ মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন জানান রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ওই বছরের ৩ আগস্ট আদালত অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন। অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দকে। দীর্ঘ তদন্তের পর তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ আরও ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১১ সালের ২ জুলাই আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। অধিকতর তদন্তে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) পাশাপাশি হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে পান তিনি। মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে সিআইডি’র প্রথম তিন তদন্ত কর্মকর্তাকেও অধিকতর তদন্তে অভিযুক্ত করেন আবদুল কাহার আকন্দ।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মোট আসামি ৫২ জন। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি হয়েছে অন্য মামলায়। বাকি আসামিদের মধ্যে ৩১ জন কারাবন্দি।
পলাতক ১৮ আসামির মধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে, বিএনপি নেতা মোফাজ্জল হোসেইন কায়কোবাদ ও হরকাতুল জিহাদ নেতা জাহাঙ্গীর বদর সংযুক্ত আরব আমিরাতে, তৎকালীন ডিজিএফআই’র কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন যুক্তরাষ্ট্রে, আরেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার কানাডায় রয়েছে। এছাড়া মাওলানা তাজউদ্দিন ও তার ভাই বাবু ওরফে রাতুল বাবু দক্ষিণ আফ্রিকায়, পরিবহন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হানিফ থাইল্যান্ডে অবস্থান করছে। আর ভারতের কারাগারে বন্দি আছে দুই জঙ্গি— আনিসুল ইসলাম মোরসালিন ও মুহিবুল ইসলাম মুত্তাকিন।
অন্য আসামিদের মধ্যে হরকাতুল জিহাদ নেতা শফিকুর রহমান, আব্দুল হাই, দেলোয়ার হোসেন জোবায়ের ওরফে লিটন, খলিলুর রহমান ও ইকবাল এবং পুলিশ কর্মকর্তা খান সাঈদ হাসান ও ওবায়দুর রহমান কোথায় আছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
কারাবন্দি থাকা আসামিরা হলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম, পুলিশের সাবেক আইজি শহিদুল হক, খোদা বক্স ও আশরাফুল হুদা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, ঢাকা সিটি করপোরেশেনের সাবেক কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম আরিফ, সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তার মুন্সী আতিকুর রহমান, আব্দুর রশীদ ও রুহুল আমিন, পাকিস্তানি নাগরিক আব্দুল মজিদ ওরফে ইউসুফ ভাট ওরফে আব্দুল মাজেদ ভাট, হরকাতুল জিহাদ ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের নেতা মাওলানা শেখ আব্দুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা ওরফে জিএম, মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা আব্দুর রউফ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার আবু জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে খাজা ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, রফিকুল ইসলাম সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, উজ্জ্বল ওরফে রতন ও আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার। তারা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন