বাসচালক-হেলপারদের ধর্ষণ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা
আশঙ্কাজনক হারে সারা দেশে বাসচালক, হেলপার ও তাদের সহযোগীদের হাতে গণধর্ষণ, ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সারা দেশে গত ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ তবে প্রকৃত অবস্থা আরও খারাপ বলে মনে করছেন তারা৷ খবর ডেয়েচে ভেলের।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর পর্যবেক্ষণ করে যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, গত ১৩ মাসে বাসচালক-হেলপার ও তাদের সহযোগীরা ৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে৷ এসব ঘটনায় ৫৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷ এর মধ্যে গত বছরের ৯ এপ্রিল মানিকগঞ্জে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি৷ যাত্রীকল্যাণ সমিতি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণও দিয়েছে৷
গত ২১ জানুয়ারি রাজধানীর দারুসসালামে চলন্ত বাসে যৌন হয়রানির অভিযোগে গাবতলী-নবিনগর রুটের বাসচালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে দারুসসালাম থানায় মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ এ ঘটনায় পুলিশ চালক ও হেলপারকে আটক করেছে৷
২০১৭ সালের ১৩ মার্চ ইজিবাইকে করে চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে আলমডাঙ্গায় ফিরছিলেন এক স্কুলছাত্রী৷ ইজিবাইকের ভাড়া মেটাতে না পারার অজুহাতে চালকসহ চারজনের ধর্ষণের শিকার হন ওই স্কুলছাত্রী৷
গত বছরেরই ৯ এপ্রিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এসআই পরিবহনের চলন্ত বাসে স্বামীর সামনে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷
৩১ জুলাই কুড়িগ্রামের রৌমারীতে পদ্মা পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা আসার পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এক কিশোরী গৃহকর্মী৷
এক মাস পর অর্থাৎ গত আগস্টে গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ট্রাকচালক মেহেদী হাসান ও হেলপার সোহান মিলে এক কিশোরীকে চলন্ত ট্রাকে ধর্ষণ করে৷ পরে পুলিশ ট্রাকের চালককে আটক করে৷
আগস্টেই রাজধানীর বনানীতে এক তরুণীকে প্রাইভেটকারে তুলে নিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা চালায় ইমরান হোসেন নামে এক ব্যক্তি৷ এই ঘটনায় ইমরানকে গ্রেফতার ও গাড়িটি জব্দ করে পুলিশ৷
আগস্টেরই আরেক ঘটনা৷ ১১ আগস্ট ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় লেগুনার চালক জয়নাল আবেদিন ও হেলপার রিপন ওই এলাকার ৭ম শ্রেণির এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণ করে৷ ছাত্রীর চাচা বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ চালক ও হেলপারকে আটক করে৷
দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঘটে ধর্ষণের আরেকটি ঘটনা৷ ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় চলন্তবাসে জাকিয়া সুলতানা রুপা নামে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷
এরপর ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে লোহাগাড়া যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বাসে এক গৃহবধুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে বাসের চালক জনি বডুয়া ও হেলপার মো. এহসানকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের কারাদণ্ড দেন৷
২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে বহদ্দারহাটে যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে চালক রাশেদুল ইসলাম ও সহকারী ইমতিয়াজ উদ্দীন এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে৷ তরুণী থানায় মামলা করলে পুলিশ ওই দুজনকে আটক করে৷
৩ নভেম্বর গাজীপুর বাইমাইল এলাকায় নৌকায় তুলে এক পোশাক শ্রমিককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে চার দুর্বৃত্ত৷ ২১ ডিসেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আনন্দ পরিবহনের বাসে ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে বাসচালক পারভেজ৷
এর আগে গত বছরের ২২ জানুয়ারি কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে নদীয়ার রেলস্টেশনে বাংলাদেশি এক নারী যাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হন৷
গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীতে বাসের ভেতরে এক নারীকে যৌন হয়রানি করে বাসচালক ইসমাইল হোসেন ও তার চার সহযোগী৷ ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় বাসে আটকে রেখে ১৩ বছরের এক কিশোরী পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে বাসের হেলপার হাফিজুল ইসলাম৷
এ ছাড়া ২১ মে কুড়িল বিশ্বরুটে মাইক্রোবাসে এক গারো তরুণী ধর্ষণের শিকার হন৷ ১৩ মে ময়মনসিংহের চুলখাই এলাকায় বাসচালক ও হেলপার মিলে ধর্ষণ করে এক তরুণীকে৷
১১ মে ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ে বাসের মধ্যে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বাসচালক ও তার সহযোগী, ৩ মে আশুলিয়ার বাস কাউন্টার থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ ২৫ এপ্রিল খিলগাঁওয়ে এক গৃহবধূকে মাইক্রোবাসে যৌন নির্যাতনের পর ওই মাইক্রোবাসে চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়৷ ১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ট্রেনে দুর্বৃত্তদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন এক নারী৷
যাত্রী কল্যান সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করেছি৷ আর এসব ঘটনায় পুলিশ সক্রিয় হয়েছে৷ অভিযোগ বা মামলাও করা হয়েছে৷ কিন্তু আমরা মনে করি, এটি প্রকৃত ঘটনা যা ঘটে তার চেয়ে অনেক কম৷ কারণ সব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না৷ আবার সবাই নানা কারণে পুলিশের কাছে অভিযোগও করেন না।
তিনি বলেন, সাধারণত গণপরিবহনের নারী যাত্রীরা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত৷ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত নারীরা গণপরিবহণ ব্যবহার তেমন করেন না৷ তাই গণপরিবহণে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না৷
তিনি আরও বলেন, সমস্যা হচ্ছে- পরিবহনে কোনো নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে তিনি কোথায় অভিযোগ করবেন ঠিক বুঝে ওঠতে পারেন না৷ এ জন্য মোবাইল কোর্ট সক্রিয় করা উচিত৷ রুট অনুযায়ী, মোবাইল কোর্টের ফোন নাম্বার গণপরিবহনের প্রকাশ্য স্থানে লিখে রাখতে হবে৷ আর মালিকদের উচিত হবে বাসের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া, মোটিভেশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করা৷
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নারীদের জন্য আলাদা বাস, যেখানে ড্রাইভার, হেলপার সব নারী হবে- এটি একটি সমাধান হতে পারে৷ কিন্তু এটি হয়তো ঢাকায় হতে পারে, সারা দেশে সম্ভব নয়৷ আর তাতে বাস থেকে নামার পর তাদের নিরাপত্তা দেবে কে? তাই সার্বিকভাবে নারীদের নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি৷ সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে৷
টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে রূপা হত্যা এবং ধর্ষণ মামলার রায়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি চারজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ একজনকে দেয়া হয়েছে সাত বছরের কারাদণ্ড৷ গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে কর্মস্থল ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে জাকিয়া সুলতানা রূপা পরিবহন শ্রমিকদের সংঘদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন৷ বাসেই হত্যার পর মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রুপার মরদেহ ফেলে দেয়া হয়েছিল৷
মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এবং মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, রূপা হত্যা এবং ধর্ষণের বিচার হয়েছে৷ এটা হয়তো আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে৷ কিন্তু গণপরিবহণে তাতে যৌন হয়রানি কমবে বলে মনে হয় না৷ আমরা এই ধরনের যৌন হয়রানির প্রচুর অভিযোগ পাই৷ আসলে অভিযোগ জানানোর বিষয়টি সহজ করতে হবে৷ কারণ, চলন্ত বাসে ঘটনা কোন থানা এলাকায় তা নিয়ে পুলিশের আইনি দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত অনেক ঘটনায়ই আর অভিযোগ হয় না৷ তাই এইসব ব্যাপারে তাৎক্ষণিক অভিযোগ নেয়ার কোনো একক ব্যবস্থা চালু করতে হবে৷
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নারীদের জন্য নারী ড্রাইভার ও হেলপার দিয়ে যদি পর্যাপ্তসংখ্যক বাস নামানো যায়, তা হলে হয়তো কিছুটা সমাধান আশা করা যায়৷ কিন্তু তার পরও সমস্যা থেকে যাবে৷ অভিযোগ দায়ের এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হলে আমি মনে করি, এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে৷ আর বাসে নারীদের যে আসন সংরক্ষণের বিধান আছে, তা সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে৷
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন