বাড়ছে কৃষিযন্ত্রের বাজার
একসময় ভারী কৃষিযন্ত্র বলতে শুধু ট্রাক্টরকেই চিনত দেশের কৃষক। সেটাও খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। কিন্তু এখন কৃষিতে ডজনখানেক বড় যন্ত্রের ব্যবহার করছেন কৃষকরা। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত সবখানেই যন্ত্র তাদের সাহায্য করছে। এসব ক্ষেত্রে ৮০-৯৫ শতাংশ পর্যন্ত যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে দেশের কৃষিখাত।
কৃষিখাত যান্ত্রিকীকরণ হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে কৃষিযন্ত্রের বাজারও। সরকার সংশ্লিষ্ট কৃষিযন্ত্রের আমদানিকারক ও স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের হিসাবে বর্তমানে এ বাজার ১০-১২ হাজার কোটি টাকার। যার মধ্যে স্থানীয় প্রস্তুতকারীরা প্রায় পাঁচশ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির জোগান দিচ্ছেন। বাকিটা আমদানিনির্ভর। সরকারি হিসাবে এ বাজার ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
দেশের বড় কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান কৃষিযন্ত্র তৈরির পাশাপাশি আমদানিও করছে। দেশে জাপানি ও চীনা কৃষিযন্ত্র বাজারজাত করছে চার-পাঁচটি কোম্পানি। পাশাপাশি দেশে কৃষিযন্ত্র তৈরির কারখানা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানিও। এর মধ্যে জাপানের ইয়ানমার ও ভারতের মাহিন্দ্র অ্যান্ড মাহিন্দ্র লিমিটেড শিগগিরই কারখানার কাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে।
দেশে কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারীদের সংগঠন এগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির তথ্যমতে, বেসরকারি পর্যায়ে ছোট বড় মিলে দেশে প্রায় ৭০ প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরি ও সংযোজনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মাঝারি ও বড় কারখানা ১০-১২টি।
সংগঠনের সভাপতি আলীমুল এহছান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের ভর্তুকি ও কৃষকের হাতে টাকা থাকায় এ বাজার বড় হচ্ছে। ইতিমধ্যে কৃষি উদ্যোক্তা অথবা কৃষক সমিতি হারভেস্টর কেনার ক্ষেত্রে অর্ধেক ভর্তুকি ঘোষণা করেছে সরকার। হাওরে এটা ৭০ শতাংশ। অন্যান্য এলাকায়ও ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। ফলে বাজার আরও বাড়ছে।
জানা গেছে, ঘোষিত ভর্তুকির আওতায় একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টর ২৮ লাখ টাকা দিয়ে কিনলে সরকার দেবে ১৪ লাখ টাকা। হাওরে ৭০ শতাংশ হারে কৃষকরা ভর্তুকি হিসেবে পাবেন ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
আলীমুল এহছান চৌধুরী আরও বলেন, ‘কৃষি ভর্তুকি বড় যন্ত্রের ক্ষেত্রে। যেসব যন্ত্র দেশে উৎপাদন হচ্ছে এমন বড় যন্ত্রে ভর্তুকি না দেয়া ভালো। কারণ তাতে দেশি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক তথ্যে দেখা গেছে, কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফসল লাগানোর আগে জমি তৈরির ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে ৯০-৯৫ শতাংশ জমিতে। শস্য রোপণে যন্ত্রের ব্যবহার এখনও কম। কারণ এ যন্ত্রটি দামি ও ভারী। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা-নেয়া বড় সমস্যা। এছাড়া ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা প্রচুর ওয়ার্কশপ না থাকা, দক্ষ চালক না পাওয়া এ যন্ত্রের প্রসারে বড় সমস্যা।
এছাড়া সব ধরনের ফসল চাষে জমি প্রস্তুত, বীজ লাগানো বা রোপণ, পাকা ফসল মাড়াই-ঝাড়াইয়ের নানা ধাপে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে। পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের বাইরে ভারী যন্ত্র বলতে মাড়াইয়ের কাজে বিভিন্ন ধরনের থ্রেশারের ব্যবহার বাড়ছে।
তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সারাদেশে ৮৮৩টি থ্রেশার বিক্রি হয়েছিল, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৪৫টিতে ঠেকেছে। ধান কাটার যন্ত্র রিপার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৩৪৮টি, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৭৬৯টিতে দাঁড়িয়েছে।
ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তাবন্দির জন্য ব্যবহার হয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, যার ব্যবহার মূলত শুরু হয় ২০১৬-১৭ তে। শুরুর বছরে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বিক্রি হয়েছিল ৭৮টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারাদেশে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বিক্রি হয় ৭৬৯টি। গত অর্থবছরের শেষে করোনার প্রভাবে এটির বিক্রি অনেক বেড়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও শেষ বছরের প্রায় দেড়গুণ হবে বলে জানান বিক্রেতারা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এক গবেষণা বলছে, চাষ, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০-৯৫ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যদিও ফসল রোপণ, সার দেয়া, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এক শতাংশের কম।
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মাঠ পর্যায়ে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মো. মঞ্জুরুল আলমের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ছোট-বড় প্রায় ৮০০ কারখানা এখন বারি ও ব্রির মডেলে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছে। এছাড়া ৭০টি ফাউন্ডারি, প্রায় দেড় হাজার যন্ত্রাংশ তৈরি কারখানা ও প্রায় ২০ হাজার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কারখানা এ কাজে জড়িত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন