বিএনপির ‘কৌশল’ জাপার ‘অবস্থান’ ভাবাচ্ছে আ.লীগকে
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৭ দিন বাকি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বড় ধরনের বা পরিকল্পিত প্রচার-প্রচারণা দেখতে পাচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এই ‘আচরণ’ কৌশল না দুর্বলতা তা ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগকে। একই সঙ্গে জাতীয় পার্টির ‘অবস্থান’ ভাবাচ্ছে দলের নেতা-কর্মীদের।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ভাবনার কথা জানা গেছে। তারা নিজেরা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন।
দলটির মধ্যম সারির একাধিক নেতা বলেন, নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। কিন্তু সারা দেশের কোনো স্থানেই বিএনপি তেমন কোনো প্রচার চালাচ্ছে না। তারা নির্বাচন কমিশন আর গণমাধ্যমে অভিযোগ করেই যাচ্ছে যে, তাদের প্রচারণা চালাতে দেওয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, নির্বাচনী মাঠে বিএনপি যতটুকু শক্তি দেখাবে বলে তারা ভেবেছিল, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। সব যেন নীরবেই সয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট। দলের সভা-সমাবেশগুলোতে নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন, কিন্তু এতে করে সারা দেশে তারা কতটুকু পৌঁছাতে পারছেন, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে।
নিজেদের প্রচারণা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষের কৌশল নিয়েও ভাবছে। আওয়ামী লীগের একটি উপকমিটির একজন সদস্য শুক্রবার বলেন, ‘বিএনপি তো এখন পর্যন্ত চুপ। সব ঠান্ডা হয়ে আছে। পরিচিত কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করছি তাদের কী পরিকল্পনা, তারা বলছে ২২ তারিখের পর থেকে জোরেশোরে নামবে।’
অবশ্য সন্ধ্যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর সব আসনে (ঢাকা-৪ থেকে ঢাকা-১৮) একযোগে জনসভা ও গণমিছিলের ঘোষণা দিয়েছে। ২৭ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশেরও ঘোষণা দিয়েছে এই জোট।
বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, ‘একটা জিনিস লক্ষ্যে করবেন নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রচার প্রচারণায় তারা (বিএনপি জোট) নেই। কারণ তারা একটা চক্রান্তে ব্যস্ত, একটা ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। আরেক জায়গায় শুনলাম তারা ভুয়া ব্যালট পেপার বানাচ্ছে। কাজেই এভাবে তারা নানাভাবে চক্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এই চক্রান্তের হাত থেকে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করতে হবে।’
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ঘেঁটে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, মানিকগঞ্জ, যশোর, চাঁদপুর, ঝালকাঠি, সিরাজগঞ্জ, কক্সবাজারসহ অন্তত ২৫ জেলায় বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। যার বেশির ভাগই প্রচারণা মিছিল বা সমাবেশে। শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে সমাবেশ করতে যাওয়ার পথেও বাধার শিকার হন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। গত ১৫ ডিসেম্বর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, বিএনপির দেড় শ’ প্রার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। একই দিন অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কোথাও কোথাও বিএনপি নিজেরাই নিজেদের ওপর হামলা করছে আর দোষ দিচ্ছে আওয়ামী লীগের ওপর।
গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, জাতীয় পার্টি ও বামপন্থী দলগুলোও কয়েকটি জায়গায় হামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। আওয়ামী লীগও এই সময়ে কোথাও কোথাও হামলার শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। ঢাকা-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ ও বিএনপির প্রার্থী আহসান উল্লাহ হাসান পাল্টাপাল্টি হামলার অভিযোগ করেছেন। গতকাল গভীর রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌর সদরে আওয়ামী লীগের দুটি অস্থায়ী নির্বাচনী প্রচারকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
সার্বিক বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগের প্রচার চালাচ্ছে। প্রতিপক্ষের দিকেও খেয়াল রাখছে। বিএনপি বা তাদের জোট ভোট থেকে সরে যাবে বলে তারা এখন আর মনে করছেন না। তবে দলটির অতীত কর্মকাণ্ড বিশেষ করে গত নির্বাচনে আগে এবং ২০১৫ সালে অগ্নি সন্ত্রাসের বিষয়টি আওয়ামী লীগের মনে আছে। ফলে ভোটের শেষ দিকে এসে দলটি কি ধরনের কর্মকাণ্ড করে সেটা নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা আছ, তারাও সেদিকে নজর রাখছেন।
ভাবাচ্ছে জাতীয় পার্টিও:
জাতীয় পার্টি (এরশাদ) নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ধোঁয়াশা কাটছে না। মহাজোট থেকে ২৭ আসন দেওয়া জাপা ২৯ আসন পেয়েছিল বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করে। পরে আরও ১৪৬ আসনে প্রার্থী দিয়ে রাখে। এর মধ্যেই এরশাদ দেশের বাইরে গেছেন। তাদের এই আসনগুলোতে প্রার্থী থাকবে কি না, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতারা তখন বলেছিল, নির্বাচনী কৌশল হিসেবে তারা জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের অন্য দলগুলো থেকেও কিছু আসনে প্রার্থী রেখে দিয়েছিলেন। একে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের ফাঁদ এড়ানোর কৌশল হিসেবে উল্লেখ করে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি নির্বাচন থেকে সরে যায়? তারপর? আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁদ তৈরি করতে দেব না।’
নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনের পরেও যেসব আসনে মহাজোটের একাধিক প্রার্থী ছিল, ইতিমধ্যেই তাঁদের কয়েকজন সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট-৬ আসনে বিকল্পধারার প্রার্থী সমশের মবিন চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন দিয়েছেন। সুনামগঞ্জ-১ আসনে রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মহাজোটের মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে সমর্থন দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন।
তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দেশে না থাকায় তাদের প্রার্থীদের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত কি হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। নেতা-কর্মীরা আশা করছেন, অন্য আসনগুলোতেও প্রার্থীরা সরে দাঁড়াবেন, নইলে নিজেদের জন্যই হিতে বিপরীত হতে পারে। জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা যত ভোট পাবেন, সেই ভোটই পারে জয়-পরাজয়ের হিসেব পাল্টে দিতে। অবশ্য ইতিমধ্যেই নোয়াখালী-৫ আসনে ওবায়দুল কাদেরকে সমর্থন দিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম বসে পড়েছেন। এ ছাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে সমর্থন দিয়ে জাপা প্রার্থী তারেক এ আদেল, নড়াইল-২ আসনে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে সমর্থন জানিয়ে খন্দকার ফায়েকুজ্জামান ফিরোজের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর খবর পাওয়া গেছে।
এ সম্পর্কে জাতীয় পার্টির রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, কৌশল হিসেবে জাতীয় পার্টি অনেক আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এখন পর্যন্ত নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে মহাজোটের শরিক দলের প্রার্থীরা মাঠে আছেন। তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে যা করার সেটা করা হবে। জাতীয় পার্টির একটি সূত্র অবশ্য বলছে শিগগিরই দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ দেশে ফিরবেন। এরপর সবকিছু পরিষ্কার হবে।-প্রতিবেদন প্রথম আলো’র সৌজন্যে প্রকাশিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন