বিএনপির স্থায়ী কমিটির পাঁচটি শূন্যপদে আলোচনায় যারা
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকটি পদ ফাঁকা। সবশেষ গত মঙ্গলবার স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে আরও একটি পদ শূন্য হলো। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন সদস্য অসুস্থ থাকায় এবং কয়েকজন বিদেশে অবস্থান করায় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিতি খুবই কম দেখা যায়।
এমতাবস্থায় স্থায়ী কমিটির ফাঁকা পদগুলো পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই পদগুলো পূরণের ঘোষণা দিতে পারে দলের হাইকমান্ড। দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির পাঁচটি পদ শূন্য। শারীরিক অসুস্থতা ও বিদেশে অবস্থান করায় চারজন সবসময়ই থাকেন অনুপস্থিত।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে কর্মসূচি গ্রহণে সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনায় কেন্দ্রীয় দিকনির্দেশনা প্রদানেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে যত দ্রুত সম্ভব শূন্যপদগুলো পূরণের চিন্তা-ভাবনা করছে হাইকমান্ড।
বিএনপিতে স্থায়ী কমিটি বরাবরই একটি আকর্ষণীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন পদ। আজীবন বিএনপির রাজনীতি করা পোড় খাওয়া নেতাদের টার্গেট থাকে শেষ জীবনে হলেও স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এ ফোরামে সাংগঠনিকভাবে যোগ্য, পরীক্ষিত, ত্যাগী ও দলে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই স্থান হয়। তাই প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া।
এ কমিটি নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত, কর্মসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজগুলো করে। স্থায়ী কমিটির সুপারিশের আলোকেই বেশিরভাগ সময় বিএনপির শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। অন্তত খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে।
বিএনপির কাউন্সিলের কথা উঠলেই অনেকে স্থায়ী কমিটির পদ বাগিয়ে নিতে নানা কৌশল ও তদবির শুরু করেন। বিএনপির পরবর্তী কাউন্সিল কবে হবে তা নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় যোগ্য, দক্ষ, নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে স্থায়ী কমিটি পূরণের কথা ভাবছে দলের হাইকমান্ড।
স্থায়ী কমিটি ছাড়াও দলের নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলোও পূরণের চিন্তা চলছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চাইলে স্থায়ী কমিটিতে শূন্যপদ পূরণ করতে পারেন। এ ছাড়া দলে আরও বেশ কিছু শূন্যপদ রয়েছে। সেগুলোও পূরণ করতে পারেন।
স্থায়ী কমিটির একজন ও কেন্দ্রীয় কমিটির দুজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করবে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। তারা হলেন— তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
এ ছাড়া রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। যদিও তার পদত্যাগপত্র বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কোনোটিই করা হয়নি।
এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুনে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই হিসাবে এখন সদস্য সংখ্যা ১৪ জন।
এখনও ফাঁকা পাঁচটি পদ। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও আইনি জটিলতাসহ পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তার রাজনীতিতে ফেরাটা অনিশ্চিত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকেই ভার্চুয়ালি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। মামলা জটিলতায় সালাহউদ্দিন আহমেদ রয়েছেন ভারতের শিলংয়ে। অসুস্থ আছেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। বয়সের কারণে বৈঠকে নিয়মিত নন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার।
রফিকুল ইসলাম মিয়া কিংবা জমিরউদ্দিন সরকারকে বাদ দেওয়ার কোনো চিন্তা আপাতত নেই। শূন্য পাঁচটি পদই এখন পূরণ করা হবে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের মার্চে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কাউন্সিলের উদ্যোগ নেয়নি দলটি। এর মধ্যে আবার গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছে। সব কিছু মিলে শিগগিরই জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না বলে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
তারা আরও জানান, দলের স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে ইতোমধ্যে হাইকমান্ড কাজ শুরু করেছেন। শিগগিরই এ পদে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। দুর্দিনে যারা বিএনপির, বিশেষ করে জিয়া পরিবারের পাশে ছিলেন এবং নানা প্রতিকূল পরিবেশেও দল ছাড়েননি— এমন পরীক্ষিত নেতার মাধ্যমে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণ করা হবে।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবদিন ফারুক, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নাম আলোচনায় রয়েছে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, প্রথমত বিএনপি অনেক ক্ষেত্রেই এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দলটিতে চলছে একটা ঢাকাকেন্দ্রিক নেতৃত্ব, লন্ডন থেকে আরেকটি নেতৃত্ব। ফলে সব মিলিয়ে দলে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাই যেভাবে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করা দরকার তা হচ্ছে না। যে কারণে সঠিক নেতৃত্ব পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্বকে আরও সামনে নিয়ে আসা উচিত। এ দলে অনেক তরুণ নেতৃত্ব আছে যারা যোগ্য, কিন্তু অবহেলিত। তাদের সামনে আনা হচ্ছে না। লন্ডন নেতৃত্ব বলেন, আর ঢাকার নেতৃত্ব বলেন; তারা নিশ্চয়ই জানেন কারা সাম্প্রতিক সময়ে দলে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এমন একটা নেতৃত্ব আনতে হবে যারা আগামী ১০ বছর দলকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে যারা বয়স্ক, ঠিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেন না তাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা প্রয়োজন। না হলে বিএনপি এক ধরনের নেতৃত্ব শূন্যতার মধ্যে দিয়ে যাবে, দলকে চাঙ্গা করতে পারবে না।
স্থায়ী কমিটির একটি পদে জিয়া পরিবারের সদস্য ও তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমানের অন্তর্ভুক্তির দাবি রয়েছে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ায় ক্লিন ইমেজের ডা. জোবায়দা দলকে গোছাতে পারবেন বলে ধারণা অনেকের। যদিও এ বিষয়ে জিয়া পরিবার কিংবা বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো নেতা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তাই অনেকে ধরেই নিয়েছেন জোবায়দা রহমানের এ মুহূর্তে স্থায়ী কমিটিতে আসার তেমন সম্ভাবনা নেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আবদুল্লাহ আল নোমান ও আবদুল আউয়াল মিন্টু জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ। তারা বিভিন্ন সময়ে দলের আস্থার মূল্য দিয়েছেন।
গতবার কাউন্সিলের আগেই স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনায় ছিলেন প্রবীণ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। এ দুজনের অন্তত একজন স্থায়ী কমিটিতে আসতে পারেন।
বিএনপির আইনজীবীদের মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন স্থায়ী কমিটিতে আসুক এমনটি চাওয়া অনেকের। খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম এ সদস্য ইতিমধ্যে আস্থা অর্জন করেছেন বিএনপি নেতাদের কাছে। বিগত দিনে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে বিএনপির হয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন।
এ ছাড়া অপর আইনজীবী নেতা বার কাউন্সিলের সাবেক সহসভাপতি ও দলের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনও গত কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোরালো আলোচনায় ছিলেন। এখন তার নামটিও আলোচনায় রয়েছে।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত। দলের দুর্দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন তিনি। তাকে দেখা যেতে পারে স্থায়ী কমিটিতে।
বিএনপির গত দুটি কাউন্সিলে দেখা গেছে, তরুণ নেতাদের মধ্য থেকে যাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দলের জন্য ত্যাগ আছে তাদের মধ্যে দু’একজনকে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়। যেমন— ষষ্ঠ কাউন্সিলে তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে সরাসরি পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরের কাউন্সিলে যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে সরাসরি পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়। তাই ধারণা করা হচ্ছে, যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের দু’একজনকে স্থায়ী কমিটিতে স্থান দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের স্থায়ী কমিটিতে পদোন্নতি পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। এ দুজনই দলের জন্য নিবেদিত। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও কমিটমেন্ট দলের সব পর্যায়ে প্রশংসিত।
সৌজন্যে: যুগান্তর
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন