‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার ঐতিহাসিক রায়’
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার ঐতিহাসিক রায় বলে মন্তব্য করেছেন এ মামলার রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সোমবার এ সংক্রান্ত আপিলের রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে এসব কথা বলেন। মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে ন্যস্ত করার সংবিধানের যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল আপিল বিভাগ তা বাতিল ঘোষণা করেছেন। একইসঙ্গে সরকারের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে বিচারপতিদের অপসারণে সংসদের ক্ষমতা আর রইল না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আজকের রায়ের পর থেকে পূর্বের মতো বিচারপতিদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ রায়ের পর থেকে জনগণের স্বার্থে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। এখানে আইন মেনেই সব হয়েছে। সংসদে পাস করা আইন সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনে বাতিল বা সংশোধন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই এখানে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের নির্বাহী বা আইন বিভাগের বিরোধের কোনো কারণ নেই।’
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ-সংক্রান্ত সরকার পক্ষের আপিল খারিজ করে রায় দেন।
বেঞ্চের অপর ছয় সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
গত ১ জুন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষামাণ (সিএভি) রাখা হয়। এরপর রোববার বিকেলে আজকের কার্যতালিকার এক নম্বরে রাখা হয় মামলাটি।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
গত ৮ মে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে টানা ১১ দিন এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আপিল শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ অ্যামিক্যাস কিউরির (আদালত বন্ধু) মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন।
অপর নয় অ্যামিক্যাস কিউরি- জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তণ অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে মতামত নিতে অ্যামিক্যাস কিউরিদের নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ।
গত বছরের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন।
এরপর ১১ আগস্ট এ রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র।
রায়ে বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।
আদালত আরো বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে এমপিরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে এমপিদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়।
বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে এমপিদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
রায়ে আরো পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।
সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়।
ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন। এরপর গত বছরের ১০ মার্চ মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষে ৫ মে হাইকোর্ট রায় দেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন