বিশ্বাসী চেতনার কবি আবদুল হালীম খাঁ

আবদুল হাই ইদ্রিছী : আবদুল হালীম খাঁ। বাংলা সাহিত্যের এক অগ্রণী পুরুষ। ৬০ এর দশকে যে ক’জন সাহিত্যিক সাহিত্য চর্চ শুরু করে খ্যাতির শীর্ষে রয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। ১৭ জুলাই ১৯৪৪ সালে টাঙ্গাইলের ভ’ইয়াপুরে জন্মগ্রহন করেন তিনি। এবছর জীবনের ৭৩টি বসন্ত পেরিয়ে ৭৪-এ প্রবেশ করেছেন। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও অসম্ভব পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তা ৪৫টি গ্রন্থ। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে আরো অনেকগুলো পান্ডুলিপি।

আবদুল হালীম খাঁ বিশ্বাসী চেতনার আধুনিক কবি। তিনি অবিশ্বাসী নন, বিশ্বাসী কবিদের একজন। খ্যাতিমান নজরুল গবেষক ও সমালোচক সাহাবুদ্দিন আহমদের ভাষায়- “কবি আবদুল হালীম খাঁর কবিতা বলে দেয় যে তিনি আধুনিক আঙ্গিকে কবিতা লিখলেও অবিশ্বাসী দলের আধুনিক কবি নন, তিনি বিশ্বাসী দলের আধুনিক কবি। তিনি সমাজ সচেতন, সাম্যবাদী মনোভাবাপন্ন বিদ্রোহী কিন্তুু সে বিদ্রোহ অবিশ্বাসীর নয়, বিশ্বাসীর এবং সে বিদ্রোহ যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তেমন অবিশ্বাসের বিরুদ্ধেও। ”

আবদুল হালীম খাঁ একজন সমাজ সচেতন কবি। তার কাব্যে দেশের রূপলাবণ্যে, আর্থসামাজিক উন্নয়নে, অনাহারীর হাহাকারে, নারীর আত্মচিৎকারে ফোঁটে উঠেছে সমাজের প্রতিফলন। প্রখ্যাত গবেষক ড. সেলিনা সাঈদের ভাষায় “. . . . . কবি আবদুল হালীম খাঁ প্রতিটি কবিতার মধ্যে দেশ, জাতি, ও সময়কে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। লিখেছেন বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব, দারিদ্র অনিয়ম, স্বৈরাচারী শাসকের জবরদস্তি ও জুলুম নিয়ে। তাঁর কবিতাগুলি বিদ্রোহ মূলক। এ বিদ্রোহ অন্যায়, অসত্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে।”

আবদুল হালীম খাঁ প্রচার বিমুখ একজন নিভৃতচারী কবি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখলেও তাঁর বড় পরিচয় তিনি একজন কবি।
সমাজসচেতন বিদগ্ধ কবি। নীরবে নিভৃতে তিনি নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। আধুনিকতার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সর্বোপরি মানবিক বিপর্যয়ে তার সরব কাব্যিক উপস্থিতিতে কবিসত্ত্বার মহোত্তম বিকাশ চমৎকার ভাবে পরিলক্ষিত হয়। দিকে দিকে ঘটে যাওয়া নানা সংঘাত আর অশান্তির লেলিহান শিখা অগ্নিদগ্ধ করে তার মানবিক হৃদয়কে। সমাজের সমস্ত অসঙ্গতিজুলুম শোষণের যাতাকালে পিষ্ট দুঃখী মানবতার নিরব ক্রন্দন তার কবিতায় মূর্তমান হয়ে উঠেছে। তিনি মায়াবী পরশে সহজ-সরল ভাষায় লিখেছেন।

প্রতিদি আমার পৃথিবীটা নতুন মনে হয়
যদিও এখানে সন্ত্রাস খুন যুদ্ধ মৃত্যু ভয়।
যদিও এখানে হতাশা শোক বঞ্চনার হিম রাত
যদিও এখানে খরা দুর্ভিক্ষ কালোবাজারীর হাত।
                                                   (প্রতিদিন আমার পৃথিবী)

তবুও কবি হতাশ নন, আশায় বুক বাঁধেন নতুন এক পৃথিবী গড়ার। নতুন এক আলোকিত পৃথিবীর জন্য কবি স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখান। আশায় বুক বেঁধে কবি লিখেন-

যে সাগরে সাঁতার কাটি
যে সাগরে দেখছি ঢেউ,
সে সাগরে কত মণি-মুক্তা
খুঁজে দেখিনি কভু কেউ।
                          (আকাশ ও সাগর)

দেশ প্রেম প্রতিটি মানুষের সহজাত বিষয়। ধনী গরিব প্রতিটি মানুষই তাঁর দেশকে ভালবাসে। একজন কবি যখন দেশ প্রেমিক হবেন তখন দেশ প্রেমে তাঁর কবিতা থাকবেই। তবে কারো কলমে সে দেশপ্রেম প্রকাশিত হয় নারীর মমতায়, সমালোচনার সুখপাঠ্যে কিন্তু আবদুল হালীম খাঁ’র দেশপ্রেম ফোঁটে উঠেছে মাটির মমতায়। কবি তার কবিতায় এ ভাবেই দেশ প্রেম প্রকাশ করেছেন-

সবুজ ফসলে ভরা এদেশ আমার
বড় অপরূপ এর নদী মাঠ বন,
ফুল পাখি লতাপাতা সোনালী খামার
সবুজ ফসলে ভরা এদেশ আমার।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
ভালোবাসি এদেশের আলো বায়ূ জল
ঘাস আর মৃত্তিকার সোঁদা সোঁদা ঘ্রাণ,
মন ভরে দেখে এর ফুল আর ফল
ভালবাসি এ দেশের আলো বায়ূ জল।
                                              (এ দেশ আমার)

আবদুল হালীম খাঁ’র কবিতায় নতুনত্বের স্বাদ অমৃত মিশ্রিত নতুন কক্ষ উন্মোচন করার মত। তাঁর নিজের চলার গতিছন্দ ও উপস্থাপনাই তাকে দিন দিন মহিমাম্বিত করে দিচ্ছে। তার কবিতা যতই পাঠ করা যায় ততই পাঠের আগ্রহ বাড়ে এবং হৃদয়ে সত্য ও সুন্দরের ঢেউ উঠে। ইচ্ছে করে বার বার আবৃতি করতে। যেমন কবি লিখেছেন-

আমার বড়ই ইচ্ছে করে আলোর পথে ছুটতে
আমার বড়ই ইচ্ছে করে নতুন সমাজ গড়তে।
আমার বড়ই ইচ্ছে করে বাতিলের সঙ্গে লড়তে
আমার বড়ই ইচ্ছে করে ইসলামী সমাজ গড়তে।
                                                     (আমার বড়ই ইচ্ছে করে)

আবদুল হালীম খাঁ’র কাব্যের গতিধারা বর্ষার দুকূল প্লাবিত প্রবাহমান খরস্রোতা নদীর মত ছুটে চলার গতিময়তায় দূরন্ত। তিনি আধুনিক কাব্য জগতে যে বাস্তবিক একজন স্বকীয় ভাবরীতিতে নতুন ভূবন নির্মতা এবং নির্ভীক ও শক্তিশালী কবিকন্ঠ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি নিজে যেমন পরিচ্ছন্ন ও কলুষমুক্ত সত্যবাদী তেমনি সত্যাশ্রয়ী মতাদর্শের উপর তার কবিতাগুলোর মুল দৃঢ় ভাবে প্রোথিত রয়েছে। কবি দেখতে চান এই রূপসী বাংলার শ্যামল মাটিতে জোসনা-ধবক গোলপ-ফোঁটা সৌম্য-শান্ত স্রষ্টা-প্রত্যয়ী একটি নিস্কলংক নতুন সমাজ। তাই তো দেখতে পাই কবির স্মৃষ্টিধর্মী মননশীল কাব্যে অস্বচ্ছ কুটিল অন্ধকার ভাঙগার ভয়ংকর বিপ্লবী আওয়াজ। বিদ্রোহী মানসে কবি লিখেছেন-

যুদ্ধ এক্ষনে একমাত্র মহৎ শিল্পকর্ম
যোদ্ধারাই মহান দেশপ্রেমিক
আজকাল দেশের সব কষ্ট পরিত্রাণের জন্য
যুদ্ধ ছাড়া আমার হাতে আর কোন কর্মসূচী নেই।
                                                     (আমি একটা যুদ্ধ চাই)
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
কোথায় আলো? আর কত দূরে
আর কতদিন আলোর সন্ধানে হাটবো?
এ কুৎসিত ক্লেদাক্ত
আঁধার বিবরে!
                              (আলোর জন্য)

কবি আবদুল হালীম খাঁ তার কাব্য প্রতিভায় দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে প্রতিবেশি দেশের গুণীজনের মনে স্থান করতেও সক্ষম হয়েছেন। কলকাতার মাসিক কপি হাউজ পত্রিকার সম্পাদক আশোক রায় চৌধুরী তাঁর কবিতার উপর আলোচনা করে লিখেছেন-“কবি আবদুল হালীম খাঁর কবিতার গায়ে আত্মদর্শন ও আত্মবিশ্লেষণের মোহন আলো এসে পড়ে কবিতাকে সুন্দর করে তুলেছে।” পশ্চিম বঙ্গের বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা মাসিক বুলবুল সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেছেন- “তাঁর ‘ইশারা’ নামের টুকরো কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও আত্মসর্পনের অপূর্ব সমাবেশ ঘটিয়েছেন কবি আবদুল হালীম খাঁ। তাঁর কবিতার ভাষা সহজ সরল অতচ ভাবের অসীম গভীরতা পাঠককে মুগ্ধ করে- ভাবিয়ে তোলে। কাব্য করার এক অসাধারণ যাদু আছে তাঁর হাতে। কবি লিখেছেন-

হাঁটতে হাঁটতে বুকে বাজে
দুঃখ ব্যথা শোক,
স্বপ্নে চমকে উঠি: আমি
কোন গ্রহের লোক।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
প্রতিদিন কত ফুল ফুঁটে হেসে
ঝরে যায়, তাও
কোনদিন কেউ এসে বললো না
‘একটা ফুল নাও।‘
                                          (ইশারা)

পরিশেষে কবি মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের ভাষায় আজ আমিও বলবো- “ কবি আবদুল হালীম খাঁ সম্পর্কে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, তিনি আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে জীবন ঘনিষ্ট যে অবদান রেখেছেন তা আগামী প্রজন্মের অবশ্য প্রতিকৃত হবেন তাতে সন্দেহ নেই। একক কাব্য সাধনায় তিনি তাঁর নিজস্ব কাব্য বলয় নির্মানে পারদর্শিতারই উজ্জল নিদর্শন রাখতে সমর্থ হয়েছেন। তা ছাড়া যখন দুর্বেধ্য আধুনিক গদ্য কবিতার ভয়াল আগ্রাসনে পাঠকগন কবিতা বিমুখ ও কাব্য সাহিত্যেও প্রতি অনিহা প্রকাশ করেছিলেন ঠিক তখনি নন্দনত্ত্বের এই মনসপুত্র সমাজ বোধ্য ও স্বতন্ত্র ধর্মী বাকরীতির মাধ্যমে কবিতা নির্মন করে অগ্রজের ভ’মিকা পালন করে কাব্যদেহে নতুন ভাবরসে প্রাণ স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বধর্মের প্রতি অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও মমত্ববোধ তাঁর কবিতার উপজিব্য বিষয়। তিনি জগত ও জীবন সম্পর্কে বড় বাস্তবমুখী। তাঁর বিশ্বাস আদর্শ কাব্য সাহিত্যের মাধমেই মৃত কল্প জাতিকে উজ্জীবিত করা সহজ সম্ভব।


লেখক
সম্পাদক : মাসিক শব্দচর
ধানসিঁড়ি, হাসান ম্যানশন, শমশের নগররোড, চৌমুহনা, মৌলভীবাজার