বিশ্বের প্রতিটি দেশে উড়বে লাল সবুজের পতাকা
সতের বছর আগে বাংলাদেশের পতাকা হাতে পৃথিবীর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিলেন এক নারী। চোখে ছিল স্বপ্ন-বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে উড়াবেন লাল-সবুজের পতাকা।
‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ নামে পরিচিত সেই নাজমুন নাহার গত ১ জুন গড়লেন রেকর্ড। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ ঘুরলেন তিনি!
কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশেই যেখানে পদে পদে রোধ করা হয় নারীর যাত্রা, সেখানে পরিব্রাজক হিসেবে ১০৫টি দেশে পা রাখার অনন্য রেকর্ড গড়লেন নাজমুন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি বয়ে বেড়ালেন দেশের সুনাম!
দেশকে এবং দেশের জাতীয় পতাকাকে পরিচয় করে দিয়েছেন পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষের কাছে! পৃথিবীর বিভিন্ন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন দেশের আদিবাসী মানুষের কাছেও পৌঁছে দিয়েছেন লাল সবুজের পরিচয়!
ইউনেস্কোর প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের একটি আশ্চর্য জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ওপর বয়ে যাওয়া ব্রিজটি সাক্ষী হয়ে রইলো এই নারীর শততম যাত্রার মাইলফলক!
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের পতাকা উড়লো জাম্বিয়া হয়ে একশোতম দেশ জিম্বাবুয়েতে! নাজমুনের ভ্রমণের সেঞ্চুরিতে তাকে সংবর্ধনা দেন লিভিংস্টোনের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়িনা!
তিনি তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, ‘নাজমুন নাহারের এই সাফল্য শুধু বাংলাদেশের নয়, সমস্ত পৃথিবীর মানুষের! একজন নারী হিসেবে নাজমুন নাহারের এই মাইলফলক সব মানুষ মনে রাখবে! নাজমুন নাহার নারী জাতির জন্য একজন বড় অণুপ্রেরণা!
বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন নাহারের শততম দেশ ভ্রমণের এই মাইলফলককে অভিনন্দন জানাই! আমি এই মাইলফলকের সাক্ষী হিসেবে আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সব মানুষকে শুভেচ্ছা জানাই!’
৩ জুন নাজমুন নাহারের ভ্রমণের সেঞ্চুরির রেকর্ড নিয়ে জাম্বিয়ার বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ‘জাম্বিয়া মেইল’ এ প্রকাশিত হয় এক প্রতিবেদন। স্টোরিটি লিখেছেন বিখ্যাত নারী সাংবাদিক মার্গারেট সামুলেলা!
ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলো আগেই ঘুরে আসা নাজমুন এখন ভ্রমণ করছেন আফ্রিকার দেশগুলিতে। এরইমধ্যে ঘুরে ফেলেছেন ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা , তাঞ্জানিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, সাউথ আফ্রিকা, লেসোথো, সোয়াজিল্যান্ড ও মোজাম্বিক!
তার স্বপ্ন বাংলাদেশের পতাকা হাতে বিশ্বের বাকি সব দেশ ভ্রমণ করবেন! তার যাত্রা অব্যাহত থাকবে পৃথিবীর বাকি দেশের পথে পথে!
নাজমুনের এ যাত্রার শুরু হয় ২০০০ সালে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামের মাধ্যমে! বাংলাদেশ গার্ল গাইড অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে তিনি এই আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন! সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন প্রথম!
নাজমুন বলেন, ‘সেদিন প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় রক্তের ভেতর যেন দেশের জন্য এক শিহরণ জেগেছিল! তখন মনে হয়েছিল যদি আমি সারা পৃথিবীতে দেশের এই লাল সবুজ পতাকা উড়াতে পারতাম!’
নাজমুনের মতে, পৃথিবীর সব দেশেই কোনো না কোনো সৌন্দর্য আছে, হয়তো কোনো দেশের পাহাড় সুন্দর, কোনো দেশের সমুদ্র, কোনো দেশের ছোট্ট কোনো মায়াবী শহর!
তবে, তার দেখা সেরা দেশ হলো সুইডেন। সেখানকার আইস হোটেল, শীতের আকাশের শতরঞ্জি অরোরা, মিডনাইট সামার, বিনয়ী মানুষ, ভালো সোশ্যাল সিস্টেম, উন্নত জীবন যাত্রা, বিখ্যাত নোবেল মিউজিয়াম দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে তাকে।
নাজমুন জানান, তার মন্টিনিগ্রো সফরের কথাও। পাহাড়ি চমৎকার ভ্যালি আর অপূর্ব লেকে ভরপুর দেশটি এখনও দাগ কেটে রেখেছে তার মনে।
আমেরিকায় গিয়ে তিনি ঘুরে দেখেছেন ইয়োলো স্টোনের ‘ওল্ড এন্ড ফেইথফুল’, ভলকানিক ২৫০ টি গেইসার বেসিন, রুট ৬৯, ৬১ এর দুপাশের সৌন্দর্য আর ওয়াশিংটনের মহাকাশ মিউজিয়াম!
পেরুর ১৪,২০০ ফিট উচ্চতার রেইনবো মাউন্টেন, মাচু পিচু খুবই ভালো লেগেছিল নাজমুনের! এছাড়াও বলিভিয়ার সালার দা উয়িনী তে দেখা লেকের নিচে লবণের খনি অভিভূত হয়েছিলেন তিনি!
আর আইসল্যান্ডের ল্যান্ডমান্নালুগার ভলকানিক পাহাড়ের বিভিন্ন রঙের ভ্যালির কথা কখনোই ভুলবেন না তিনি!
পৃথিবীর এতগুলো দেশ এভাবে ঘুরে আসা! নিশ্চয়ই খুব কঠিন কাজ! নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চয়ই খেয়াল রাখতে হয়েছে তাকে?
এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুন বলেন, ‘নিরাপত্তার সমস্যায় আমাকে খুব একটা কখনও পড়তে হয়নি। কারণ আমি পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছি, সেখানকার ইয়ুথ হোস্টেলে থেকেছি। আর যেখানেই গিয়েছি, সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতা পেয়েছি।
আমি দেখেছি, পৃথিবীর সব প্রান্তেই, স্থানীয়রা খুব ভালো হয়। তারা যখন দেখে কেউ আগ্রহ নিয়ে তাদের দেশ দেখতে এসেছে, তথন তারাই নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এতগুলো দেশ ঘুরে আমার কাছে একটা জিনিস খুব পরিস্কার। সেটি হলো, ভয় পাওয়া মানেই পিছিয়ে পড়া। ভয়কে যে জয় করতে পারবে, সে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে।
নতুন দেশে যাওয়ার আগে অনেকের মনেই অজানা একটা ভয় কাজ করে। কিন্তু সাহস করে একটা স্টেপ নিয়ে ফেললে, সেই ভয়টি আর থাকে না। অজানাকে জানার যে আনন্দ- সেটা উপভোগ করতে হবে।’
নিরাপত্তার ভয়ে নারীরা ভ্রমণে পিছিয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নারীদের কোনো ভাবেই থামলে চলবে না! কোথাও কোনো ভয় নেই পৃথিবীর পথে পথে! যাত্রা শুরু করলেই দেখা হবে অনেক ভালো মানুষের সাথে পৃথিবীতে! শুধু সাহসী স্টেপ নিতে হবে!
স্বপ্ন দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে হবে! একটু সতর্ক থাকলেই নিজেই নিজেদে নিরাপদ রাখা যায়। যে কোনো দেশের ইয়ুথ হোস্টেলগুলো থাকার জন্য আদর্শ। ফিমেল ডর্মে থাকলে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভালো। মিক্সড ডর্মে থাকলেও কোনো সমসা নেই। কারণ, যারা ভ্রমণ করেন, তারা আসলে সবসময় একটা আবিষ্কারের নেশায় থাকেন, কারও ক্ষতি করার মানসিকতা তাদের থাকে না।’
নাজমুন থামতে চান না এখনই। বিশ্বের প্রতিটি দেশে তিনি উড়াতে চান বাংলাদেশের পতাকা। নাজমুন দৃঢ় প্রত্যয়ী- এই স্বপ্ন তিনি পূরণ করবেনই!
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন