ঈদে মিলাদুন্নবী
বিশ্ব মানবতার আলোক বর্তিকা মহানবী (সাঃ)
বিশ্ব মানবতার আলোক বর্তিকা মহানবী (সাঃ)
আলহাজ্ব প্রফেসর মোঃ আবু নসর
১২ই রবিউল আওয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:)। সকল ঈদের চেয়েও উত্তম ঈদ হলো ঈদে মিলাদুন্নবী। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তথা ১২ই রবিউল আওয়াল রোজ সোমবার হযরত মুহাম্মদ (সা:) পবিত্র মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জুন, ১২ রবিউল আওয়াল ১১ হিজরী একই দিনে সোমবার ৬৩ বৎসর বয়সে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা।
রবিউল আওয়াল মাস মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার কারণ এটি রাসুল (সা:) এর জন্মগ্রহণের মাস। এই পবিত্র মাসেই বিশ্বনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে পৃথিবীতে আল্লাহপাক শান্তির অমিয় বানী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১২ রবিউল আওয়াল যেই দিন ও যেই মুহুর্তে মহানবী (সা:) এর ধুলির ধারায় আগমন করেন, সেই দিন ও সেই মুহুর্তটি বিশ্বজগতের জন্য মহানন্দের দিন। কেননা তিনি সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ট মহাপুরুষ ও মহামানব। তিনি বিশ্বমানবতার প্রতীক ও সত্য সুন্দরের বানী বাহক। তার পরশ পাথরে যাযাবর বর্বর আরবজাতি একটি সুমহান জাতিতে পরিনত হয়। উৎপীড়ন নির্যাতিত মানুষসহ সকল শ্রেণীর মানুষের ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু।
রাসুল (সা:) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে হেরা গুহায় নবুয়াত লাভের পর ইসলামের বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মক্কাবাসীর অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ সেপ্টেম্বর মদিনায় হিযরত করেন। তার তাওহীদের বাণী প্রচারে আরব জাহানে নবজাগরণ সঞ্চারিত হয়, নতুন সভ্যতা সংস্কৃতির উন্মেষ ও আবির্ভাব ঘটে এক নতুন জীবন ব্যবস্থার। অচিরেই নতুন সভ্যতা, ঐক্য, শান্তি, সাম্য ও মানবকল্যাণের চিন্তা-চেতনা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সার্বিক চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে। নবুয়ত প্রাপ্তির মাত্র ২৩ বৎসরের ব্যবধানে এত বড় অভাবনীয় সাফল্য আর কোন নবী রসুল বা মহাপুরুষ অর্জন করেন পারেননি।
রাসুল (সা:) এর চরিত্র সমস্ত্র পাঁক কোরআন। রাসুলের (সা:) জীবন মূলত কোরআন কেন্দ্রিক। রাসুল (সা:) এর জীবন হলো জীবন্ত কোরআন। রাসুল (সা:) এর জীবনী তলাবিহীন মহাসাগর। বিশ্ব মানবতার আলোক বর্তিকা নবীজির (সা:) জীবনের প্রধানতম দুইটি দিক। যথা ১. জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধারাবাহিক ঘটনাবলীর বিবরণ, যা ‘সিরাত’ নামে পরিচিত। ২. দৈহিক/শারীরিক অবয়বের বিবরণ, যা ‘শামায়েল’ নামে পরিচিত। মুসলমানদের জীবন পথের পাথেয় সংগ্রহের জন্য নবীজির (সা:) ‘সিরাত’ আলোচনা যেমন জরুরী তেমনি নবীজির (সা:) প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের প্রমানের জন্য ‘শামায়েল’ আলোচনাও জরুরী।
হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রা:) বলেন, ‘একবার পূর্ণিমার রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসুলুল্লাহ (সা:) লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত ছিলেন। আমি একবার রাসুলুল্লাহ (সা:) এর চেহারার দিকে আরেকবার চঁাদের দিকে তাকালাম। দেখলাম পূর্ণিমার চঁাদের চেয়েও রাসুল (সা:) অধিকতর সুন্দর।
নবী রাসুলগণ মানবী ও মানবতাবাদী। তঁারা জ্ঞানের ধারক ও বাহক। তাদের কাছে মানবতা জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ। মানবকল্যানের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিভাবক হলো আল-কোরান। আল-কোরান গুণবাচক নামের তাৎপর্য। কোনো বিশ্ববাসীর ও মানবজাতির জন্য অল্লাহতালার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। কোরান জ্ঞান ও ক্ষমার ফল্গুধারা। আল-কোরান শুধু মমিনদের সম্পদ নয়, বিশ্বমানবের সম্পদ। ৩০ পারা কোরনে সমগ্র মানবজাতির কল্যান নিহিত। মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল কোরান মানবতার কাণ্ডারী। মহাগ্রন্থ আল কোরান আল্লাহর বানী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর ওপর নাজিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। হযরত (মুহাম্মদ (সা:) এর বানীগুলি শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীর সব মানুষের জন্য। মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (সা:) প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির একমাত্র উপলক্ষ এই বিষয়টি মনে রেখেই তঁাকে মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যথায় হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর অমূল্য জীবন ও আদর্শের অবমূল্যায়ন করা হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, হে নবী আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে সমগ্র বিশ্বের কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না। সুতরাং যাকে উদ্দেশ্য করে এই পৃথিবী সৃষ্টি, তাঁকে ছাড়া এই পৃথিবীর অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। তঁার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও অলৌকিক ঘটনা তঁার সর্বশ্রেষ্ট রাসুল হওয়ার পক্ষে সন্দেহাতীতভাবে জলন্ত প্রমান বহন করে। বিনয় ও নম্রতা ছিল রাসুল (সা:) এর ভূষণ। আল্লাহর হুকুম এবং রাসুলের (সা:) জীবন দর্শন মানলে সবখানে শান্তি। উল্লেখ্য যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর পূর্বে যে সকল নবী রাসুল এসেছিলেন তা নিজ কওমের বা নির্দিষ্ট কোন বিশেষ অঞ্চলের লোকদের হেদায়েরত করার জন্য। তারা সবাই ছিলেন আঞ্চলিক ও জাতীয় নবী। কেউ বিশ্বনবী ছিলেন না। আর তাদের কারো উম্মতের উপর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা:) সর্বশেষ নবী ও রাসুল হওয়ার কারণে তার উম্মতের উপর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ইসলাম কোন জাতির জন্য নয়, কোন বর্ণের জন্য নয়, কোন বিশেষ অঞ্চলের জন্য নয়, ইসলাম এসেছে বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য। বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী হিসেবে তাই তিনি বিশ্বনবী, সর্বশ্রেষ্ট নবী ও মহামানব। নবীপ্রেম ঈমানের অন্যতম শর্ত। মুহাম্দ (সা:) এর সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা চেতনা, কর্মদক্ষতা ও ন্যায়পরায়নতা ছিল অসাধারণ, অনন্যসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী। মানবতার মুর্ত প্রতীক হযরত মুহাম্মদ (সা:) ছিলেন আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সেতুবন্ধন। মহানবী (সা:) সর্বাপেক্ষা সফল রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অতুলনীয় ও অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক। তিনি পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের আলোকে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ট রাসুল ও বিশ্বনবী মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা:)। রাসুল (সা:)এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হলো মিরাজ এবং মিরাজ হলো রাসুলের একটি বিশেষ মোজেযা। বিশ্বনবীকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠানো হয়েছে।
ইসলাম আমাদের মানসিক, দৈহিক ও আত্ত্বিকভাবে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ উপমা হযরত মুহাম্মদ (সা:)। তিনি প্রেরিত হয়েছেন সুমহান নৈতিক গুণাবলীর (মূল্যবোধ) পূর্ণতা সাধনের জন্য। উল্লেখ্য যে, মাইকেল এইচ হার্ট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন মণীষীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ত্রমাণুসারে হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে সর্ব প্রথম সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বিশ্বনবী (সা:) জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা:) যে যুগে পৃথিবীতে আবিভুর্ত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মণীষী বলা হবে না বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মণীষী। আর বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা:) ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যার কথা ও কাজের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায় নি।
রবিউল আওয়াল মাসে আমাদের বেশী বেশী মহানবী (সা:) এর জীবনাদর্শ নিয়ে আলাচনা এবং এর বাস্তবায়নের চেষ্টা করা উচিত। তঁার জীবনাদর্শ, চরিত্র ও জীবন দর্শন আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষনই আলোচনা করতঃ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। তঁার চরিত্র ও আদর্শ আমরা জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারি না বলে আমাদের জীবনে শান্তি আসে না। আমাদের মনে এক, মুখে আর এক কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই বলেই আমরা রসুলুল্লাহ (সা:) এর আদর্শ ও চরিত্র জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারি না। আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র জীবন বিধান ইসলামের আলোকে এবং রাসুল (সা:) এর রেখে যাওয়া মডেল অনুসারে সমাজ ও রাষ্ট্রের পূর্ণগঠনই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত।
লেখক:
প্রফেসর মোঃ আবু নসর
সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ,
সাতক্ষীরা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন