বিষাক্ত দাম্পত্য থেকে মুক্তি: এক বাবার সংগ্রাম ও নতুন জীবন শুরু

১৪ বছরের দাম্পত্য জীবনের প্রথম দুই বছর কেটেছে শান্তির ছায়ায়। কিন্তু বাকিটা—অস্থিরতা, পরকীয়া, মানসিক নির্যাতন আর সমাজের তীব্র কটূক্তির মধ্যেই কাটেছে। খুলনার পাইকগাছা পৌর সদরের নবপল্লীর প্রবীর সরদারের জীবন যেন দীর্ঘ ১২ বছর ধরে আগুনে পোড়া এক দগদগে নথি।

বাক্‌প্রতিবন্ধী ছেলেকে প্রতিদিন আগলে ধরে, অপমান গিলে খাওয়া এই মানুষের চোখে আজ উপচে পড়ছে শুধু একটাই শব্দ—“মুক্তি।”

সেই মুক্তির প্রতীক হিসেবেই সোমবার (২৪ অক্টোবর) সকালে পাইকগাছা পৌরসভার কেন্দ্রীয় মন্দিরে দুধ দিয়ে গোসল করে নতুন জীবনের সূচনা ঘোষণা করেন প্রবীর। প্রবীরের ভাষায়, “দোষ বা অপবিত্রতা নয়, আমি আজ সম্পর্কের বিষাক্ততা থেকে মুক্ত হলাম।”

রিংকু মণ্ডলের পরকীয়ার ছায়া শুরু থেকেই প্রবীরের বিবাহিত জীবনে ঝড় তোলে। রিংকু পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির হাওলী গ্রামের নির্মল মণ্ডলের কন্যা। বহু বছর আগে তার বিয়ে হয় প্রবীর সরদারের সঙ্গে। শুরু থেকেই আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা গেলেও, ছেলের কথা ভেবে সব সহ্য করেছেন প্রবীর।

প্রবীর অভিযোগ করেন—রিংকু বিভিন্ন সময়ে অনৈতিক সম্পর্কের জড়িত হন। হাতেনাতে ধরা পড়লেও বারবার সমঝোতা, সালিশ এবং বোঝানো সত্ত্বেও তার পরিবর্তন হয়নি। পরকীয়ার ধারাবাহিকতায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন প্রবীর। ঘরে ফিরলেও রিংকু কখনোই পরিবারিক দায়িত্ব নিতেন না।

পরিস্থিতা চরম আকার নেয় যখন রিংকু রাতের বেলায় স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে অবাধ যোগাযোগ শুরু করেন। স্থানীয়দের নজরেও আসে বিষয়টি।

গত ১৩ অক্টোবর ২০২৫ সকালে প্রবীর কাজের জন্য ভারত যান। সেই সুযোগে রিংকু পাইকগাছা পৌরসভার একটি ভাড়া বাড়ির মধ্যে নিজেই নিত্যানন্দ (৩২) নামের যুবককে নিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা সন্দেহজনক নড়াচড়া টের পেয়ে তাদের আপত্তিকর অবস্থায় ধরা দেন। এলাকাবাসী তাদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখে এবং বিচ্ছেদমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়।

প্রবীর সরদারের জীবন শুধু দাম্পত্য নির্যাতনের গল্প নয়—এটি এক বাবার সংগ্রাম, যিনি বাঁচাতে চেয়েছেন নিজের বাক্‌প্রতিবন্ধী ছেলেকে। চিকিৎসা, যত্ন ও দায়িত্ব—সবই তার কাঁধে।

প্রবীর বলেন, “ছেলের মুখ দেখে ভাবতাম, সব মেনে নেবো। কিন্তু আর পারছিলাম না। আজ আমি নতুন মানুষ। সমাজ যা বলুক, আমি আমার জীবন থেকে বিষাক্ততা দূর করেছি।”

এই ঘটনার পর নবপল্লী, পাইকগাছা ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলছেন—রিংকুর আচরণ আগে থেকেই জানা থাকলে পরিবার ব্যবস্থা কেন নিল না? সমাজপতিরা কেন দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন না? এক বাক্‌প্রতিবন্ধী শিশুর ভবিষ্যৎ না ভেবে কেন এমন নৈতিক অবক্ষয় চলতে দেওয়া হলো?

স্থানীয়রা বলছেন, “এ ধরনের ঘটনা রোধে সমাজ, পরিবার ও প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন।”

১২ বছরের অশান্তি আর পরকীয়ার আগুনে পুড়ে যাওয়া এই মানুষের চোখের জল আজ শুকিয়ে গেছে। তিনি দাঁড়িয়েছেন নতুন পথের সামনে। বাক্‌প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে নতুন করে জীবনের লড়াই শুরু করতে চান তিনি।

প্রবীরের শেষ কথা, “আমি চাই আমার ছেলে যেন শান্তিতে বড় হয়। আমার জীবনের যে আগুন ছিল—আজ সেই আগুন নিভে গেছে। আজ থেকে নতুন জীবনের সূচনা হলো।”

এমন দৃঢ়তা, মানবিকতা ও নতুন প্রত্যাশার গল্প সত্যিই সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পাইকগাছার প্রবীর সরদারের জীবন এই বার্তা দিচ্ছে—অসাম্প্রদায়িক নৈতিকতা, সাহস ও দায়িত্বের জন্য কখনোও সময় আসে না দেরিতে; জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই তা প্রয়োজন।