২৫০ নারী শ্রমিকের উদ্যোক্তা
বুটিক শিল্পে সফল জীবন সংগ্রামী শাহানা পারভীন
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শাহানা পারভীন। দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে সুখেই চলছিল তার সংসার। বিধির বিধান, স্বামী শহিদুল ইসলাম লাল ২০১৪ সালে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন পরপারে। এক প্রকার মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হলেন তিনি। চিন্তা শুরু হলো তার সংসার চালানো নিয়ে। কিভাবে চলবেন দুই পুত্রকে নিয়ে! সমাজে নানা মানুষ নানা মন্তব্য করে বসতেন। হয়ে গেলেন সমাজের অবহেলার পাত্র। একটি ভালো পোশাক, একটু ভালো খাবার রান্না করলেই সমাজের বিভিন্ন মানুষ তাকে তিরস্কার করতো বিধবা বলে। কিন্তু তিনি তাদের কথায় কান না দিয়ে মনকে শক্ত করে ছাত্রী অবস্থায় শখের বসে যে বুটিকের কাজ করতেন সেটাকেই নিলেন সঙ্গী হিসেবে। শুরু হলো তার বুটিক শিল্পের যাত্রা।
এই নারী উদ্যোক্তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার মেঘাই পুরাতন বাজার এলাকায়।
প্রথমে নিজ বাড়িতেই কাজ করতেন। তবে এখন কাজের প্রসার ঘটায় ‘ইচ্ছা পূরণ’ নামের একটি কারখানা ও শো রুমও করেছেন উপজেলা সদরের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে। সেখান থেকেই চলে এখন ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানটির কাজে সহযোগিতা করেন দুই সন্তান ও তিনজন নারী।
জানা গেছে, এই উদ্যোক্তা অনেক আগে থেকেই এলাকার গরিব দুঃখী, অবহেলিত- অসহায়দের বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করতেন। সুখ দুঃখে বিভিন্ন সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
জানতে চাইলে উদ্যোক্তা শাহানা শোনান তাঁর সংগ্রামী জীবনের গল্প। দেশের বাইরে স্বামীকে ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে বহু টাকা খরচ হয়ে যায়। এতে পুরো পরিবারই এক প্রকারের ভেঙে পড়ে। শেষমেষ মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। ছোট দুইটি ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন নিজেই। বর্তমানে এই উদ্যোক্তার বড় ছেলে রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যাণ্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি কমপ্লিট করে তুরস্কে পড়াশোনা করার জন্য আবেদন করেছেন। ছোট ছেলেটি পড়াশোনা করছেন দশম শ্রেণিতে।
প্রবল ইচ্ছে শক্তি আর মনবলকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে নিজ বাড়িতেই বিদ্যালয়ের নির্ধারিত ডিউটি শেষে নিজে একাই কাজ শুরু করেন বাটিকের। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দুই একজন বিধবা ও স্বামী পরিত্যাক্তাকে এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য নিযুক্ত করেন। প্রথম পর্যায়ে বিনামূল্যে তাদেরকে বুটিক শিল্পের কাজগুলো শিখিয়ে দেন। কাজ শেষে কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন তাদের। তবে কাজ শেখাতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাতে হাল ছাড়েননি। এখন তার আওতায় কাজ করেন বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ২৫০ নারী শ্রমিক। এদের মধ্যে তিন জনকে রেখেছেন বেতন দিয়ে। আর অন্যরা কাজ করেন প্রোডাকশন এর উপর। যে যত বেশি কাজ করে দিতে পারবে তত টাকা পাবেন। তিনি ছাত্রী অবস্থায় এই শিল্পের উপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তার মধ্যে রয়েছে, বিসিক, বিডা, রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি ইত্যাদি।
এখানে তৈরিকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, বেরি, পাঞ্জাবি, কুঁশিকাটা, ফতুয়া, শাড়ী, মেয়েদের ত্রি-পিচ, কাঁথা, নকশি কাঁথা,বেড শিট, এপ্লিকেটিভ চাদর, শীতের বাহারী চাদর, শিশুদের জামা, বাটিক, শিশুদের জুতো, টুপি, পাটের ব্যাট, পাপোশ সহ শতাধিক বিভিন্ন নামের পণ্য। শিশুদের পোশাকগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ এখানে অর্ডার করে বিভিন্ন অনলাইন মার্কেট শপ গুলো। দেশের বিভিন্ন শপিংমলে শোভা পায় ‘ইচ্ছা পূরণ’র এই পণ্যগুলো।
এখানকার তৈরিকৃত পণ্য দেশের গলি পেরিয়ে বিদেশেও স্থান পেয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকা থেকে ২২শ টাকা প্রতি পিচ মূল্যের ২০টি বেডশিট এবং ২৩শ টাকা প্রতি পিচ মূল্যের ২০টি এপ্লিকেটিভ চাদরের অর্ডার এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। সেগুলো তৈরির কাজও প্রায় শেষের দিকে। ‘ইচ্ছা পূরণ’ প্রতিষ্ঠানটিতে তৈরি পোশাকগুলো মানসম্মত ও সীমিত লাভে বিক্রি করা হয়। ফলে এখানকার পণ্যের চাহিদাটা অনেক বেশি।
২৫০ শ্রমিক বাবদ মাস শেষে এই প্রতিষ্ঠানের মালিককে গুণতে হয় প্রায় ২লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। শ্রমিক ও কাচামালের খরচ বাদে মাস শেষে তার আয় থাকে ৫০ হাজার টাকা। কোন কোন মাসে আবার এই চাহিদা বাড়লে ৭০-৮০ হাজার টাকাতেও চলে যায়। তবে করোনাকালীন সময়ে কিছুটা লোকশানের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি।
‘ইচ্ছা পূরণ’ নামের বুটিক শিল্পের এই প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা শাহানা পারভীন বলেন, “স্বামীকে হারিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে আমি খুব কষ্টে দিনাতিপাত করি। এই সময় আমাকে বিধবা বলে সমাজের অনেক লোক উপহাস করতো৷ কিন্তু আমি কোন ভাবেই মনবল হারাইনি। এলাকার বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা, অসহায় দুঃস্থ নারীদের নিয়ে এই কাজ শুরু করি। আমি এই অসহায়দের সেবা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।”
তিনি আরো জানান, “কোয়ালিটি সম্পন্ন কাপড় তৈরিতে আমরা অভ্যস্ত। কেউ যেন প্রতারিত না হয় সেদিকে পুরো খেয়াল রাখি। সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতো তাহলে আমি আরো ভালো সেবা দিতে পারব।” কেউ যদি বুটিকের কাজ শিখতে চায় তাহলে বিনা মূল্যে শেখানো হবে এবং তাদেরকে কাজ দিয়ে সহযোগিতার আশ্বাসও দেন এই নারী উদ্যোক্তা।
কাজিপুর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা চিত্রা রানী শাহা জানান, “আমাদের দিক থেকে সব ধরনের পরামর্শ থাকবে। সব সময় তার প্রতিষ্ঠানের দিকে আমাদের সু দৃষ্টি থাকবে যেন সে আরো এগিয়ে যেতে পারে।”
কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হাসান সিদ্দিকী জানান, “আমরা এই উদ্যোক্তার বিষয়ে জানি। যে কোন প্রয়োজনে আমাদের স্মরণাপন্ন হলে আমরা তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।”
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন