বিশেষ ফিচার
বেগম রোকেয়ার স্বপ্নকে ছাড়িয়ে শিক্ষার স্বপ্ন শিখরে পৌঁছে গেছে নারীরা
মোঃ আলমগীর হোসেন
শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। সকলের সম্মিলিত সেই আলো সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করে। সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে আজ থেকে চারশত বছর আগে ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের উক্তি “শিক্ষা শক্তি”। সে সময় শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চায় ইউরোপের দেশগুলো এগিয়ে গেলেও বিশ্বের বৃহৎ ভুখন্ড ভারতীয় উপমহাদেশ পড়ে থাকে অন্ধকার ও কুসংস্কারচ্ছন্নতাকে আকড়ে ধরে। হাজার বছরের পুরুষ শাসিত পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থায় মেয়ে শিশুদের বেড়ে উঠতে হতো শিক্ষা ছাড়াই। বৈষম্য নিয়ে শুরু হতো মেয়ে শিশুদের জীবন। পরিবার থেকেই দেওয়া হতো একের পর এক বিধি নিষেধ। ঘরের বাইর পা দিলেই শত শত নিয়ম কানুন। সব মিলিয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে পায়ে পরিয়ে দেওয়া হতো অদৃশ্য শিকল। মানুষ হয়েও তারা পটে আকা ছবির মত স্থির ও নিশ্চুপ। না আছে কোনো শব্দ, না আছে ঘুরে দাড়ানোর শক্তি। সেই পিছিয়ে পড়া, বৈষম্য, কুসংস্কার ও অন্ধকারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজের চিত্র সবার সামনে তুলে ধরে ছিল বেগম রোকেয়া। উপমহাদেশের নারী সমাজের নিকট শিক্ষার আলোকবর্তিকা। সুসাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী ও আধুনিক সমাজ সংস্কারক। সকল সামাজিক অসঙ্গতি, ধর্মীয় গোড়ামী ও অন্তপুরবাসিনী নারীদের মুক্তির দূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া হোসেন।
আজকে শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হয় তাদের সুপ্ত প্রতিভা।, শিক্ষা ছাড়া নারীর অগ্রগতি ও মুক্তি সম্ভব নয়। তিনি নারী শিক্ষার জন্য সকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে এগিয়ে যান। তিনি তার নিজের, পরিবারের ও সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন নারী যদি শিক্ষিত না হয় তবে নিজেদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে না। আর নারীদের প্রকৃত মুক্তির জন্য দরকার অর্থ উপার্জন বা আয় করার ক্ষমতা। এজন্য তিনি জীবনের প্রথম দিকেই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। নিজের বিভিন্ন লেখায় শিক্ষাকে নিয়ে এসেছেন। লেখায় চারপাশের বিভিন্ন প্রচলিত উপমা ও উপকরণ ব্যবহার করেছেন এতে মানুষ যেন নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। নারী শিক্ষার বিষয়ে তিনি লেখেন, “শিক্ষা স্ত্রী লোক- পুরুষ নির্বিশেষে সর্বদা বাঞ্ছনীয়। স্থলবিশেষে অগ্নি গৃহদাহ করে বলে কি কোন গৃহস্থ অগ্নি বর্জন করতে পারে”। শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে তিনি আরো বলেন, ‘অন্ততঃ পক্ষে বালিকাদিগকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতেই হইবে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি, গোটা কতক পুস্তক পাঠ করিতে বা দু’ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা- যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী, আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ মাতা রূপে গঠিত করিবে। শিক্ষা মানসিক ও শারীরিক উভয়বিদ হওয়া চাই। তাহাদের জানা উচিত যে, তাহারা ইহজগতে কেবল সুদৃশ্য শাড়ি, ক্লিপ ও বহুমূল্য রত্নালঙ্কার পরিয়া পুতুল সাজিবার জন্য আইসে নাই, বরং তাদের বিশেষ কর্তব্য সাধন নিমিত্ত নারী রূপে জন্মলাভ করিয়াছে। তাহাদের জীবন শুধু পতিদেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্ত উৎসর্গ হইবার বস্তু নহে। তাহার অন্ন, বস্ত্রের জন্য কাহারো গলগ্রহ না হয়।
রোকেয়ার স্বপ্নের সাথে আজ আমাদের দেশের নারী শিক্ষার তুলনা করলে দেখি, আমরা তাঁর স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার নারী শিক্ষায় বিশ্বে রোল মডেল। তিনি নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য ২০১৪ সালে ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কারে ভূষিত হন। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এর যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ ও সকল ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
একদশক আগে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ছাত্রী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ যা বর্তমানে শতভাগে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে ছেলে শিক্ষার্থীর তুলনায় মেয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাত যথাক্রমে ৫০.৭৫ ও ৫৩.৯৯ শতাংশ। আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরা আজ ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। এ যেন বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আজ আমরা দেখি বেগম রোকেয়ার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
সাহিত্যিক হিসেবে বেগম রোকেয়া ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে। নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী, নবপ্রভা, মহিলা, ভারত মহিলা, আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নও, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কুফল, নারী শিক্ষার প্রতি তার নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অনাচার ও অপমানের কথা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে তাঁর দুরদর্শী চিন্তাভাবন তাঁর সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তার লেখনি ছিল সোচ্চার। রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী প্রভৃতি। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক রচনা ও অনুবাদ।
নারীর স্বাধীনতা, মুক্তির এবং বৈষম্যের বিষয়ে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলেছিলেন বেগম রোকেয়া। সেই সময়ের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেছিলেন, সামাজিক বিধিব্যবস্থার উপর আমাদের (নারীদের) কোন হাত নাই। উড়িতে শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া দেওয়া হয়- তদ্ব্যতীত সামাজিক রীতি-নীতির কত শত কঠিন শৃঙ্খল পদে পদে জড়াইয়া আছে”।
মুসলমান মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের দাবী আদায়ের জন্য ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি’। এই সমিতি থেকে নারীদের আর্থিক সাহায্য এবং কর্মমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হতো। সেই অর্থে নারীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সূচনা করেন বেগম রোকেয়া। নারী শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়ে বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন বস্ত্র উপার্জন করুক। কার্যক্ষেত্রেও পুরুষের পরিশ্রমের মূল্য বেশী, নারীর কাজ সস্তায় বিক্রয় হয়।’ উপমহাদেশের পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের প্রতি নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও পর্দা প্রথার নামে অবরুদ্ধ জীবন বেগম রোকেয়াকে বেদনাহত করে তুলেছিল। তাই তিনি শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মাধ্যমে চেয়েছিলেন নারীর প্রকৃত মুক্তি।
নারীর অগ্রগতির জন্য আজীবন সংগ্রামী রোকেয়ার অগ্রণী ভূমিকা ছিল নারীর আলোকিত জীবনের জন্য। একাধারে স্কুল পরিচালনা করা, কুসংস্কারচ্ছনা সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করা ও লেখনির মাধ্যমে নারীর সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে তোলা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বেগম রোকেয়ার সার্বক্ষণিক ভাবনায় ছিল নারীদের উন্নয়ন। নারীদের স্বপ্ন ও চিন্তাকে গন্ডির মধ্যে আটকে রাখা যাবেনা। যে কাজ সমাজে পুরুষ করতে পারে তা নারীও পারবে। কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিভাজন সমাজ আর চায়না। নারীরা ও মেনে নিবে না। নারীর উন্নয়নে তাঁর কাজের পথে যারা বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল তাদের জবাব দিয়েছেন এইভাবে, ‘স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে যদি স্বাধীনতা হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ হইব। আমাদের কী হাত নেই, পা নেই, বুদ্ধি নেই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীগৃহ কার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?’ এ ছাড়াও তিনি বলেছেন, ‘আমরা (নারীরা) যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক।’
স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেই বেগম রোকেয়ার এই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়েছিলেন হাজার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই জাতির পিতা একইসাথে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পূনর্গঠন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও উন্নয়ন শুরু করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পূনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষ সমতা ও সমানাধিকার নিশ্চিত করেন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম জাতির পিতাই নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত করেন এবং প্রথম সংসদেই নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে গত দশ বছরে বিভিন্ন নীতি, কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। যার ফলে আমাদের দেশে জেন্ডার বৈষম্য যেমন কমেছে তেমনি নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের বৈশ্বিক সূচক ও মাপকাঠিতে বাংলাদেশ অভুতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। আজ বাংলাদেশের নারীরা বিচারক, সচিব, মেজর জেনারেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর।
বেগম রোকেয়ার দেশের নারীরা সামরিক, বিমান চালনা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যবসা ও শিল্পোদ্যোগসহ সব ক্ষেত্রেই সফলতার সাথে কাজ করছে। নারী শিক্ষা, উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও সমানাধিকার অর্জনের মাধ্যমে এদেশের নারীরা বেগম রোকেয়ার সকল স্বপ্ন পুরণ করেছে। ৯ ডিসেম্বর সুসাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী, সমাজ-সংস্কারক বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতি বছর মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন ও দেশের আলোকিত পাঁচজন নারীকে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করে থাকে। আদর্শ ও অনুপ্রেরনার উৎস এবং কর্মময় জীবনের অধিকারী মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার স্মৃতির প্রতি এই দিনে রইল গভীর শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র: পিআইডি ফিচার
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন