ব্যাংক খাতে সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগে নতুন শঙ্কা

ব্যাংকিং খাতে চলমান সঙ্কট দূর করতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে তা কতখানি সুফল দেবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের সুফল যদি সঙ্কটে পতিত ব্যাংকগুলো না পায় তাহলে সেগুলো আরো সঙ্কটে পড়বে। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত নিয়ে আরো গভীর সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ কোটি টাকা প্রায়। এর মধ্যে সরকারি আমানত প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। আর বাকি ৮ লাখ কোটি টাকা আমানত এসেছে বেসরকারি খাত থেকে। এর মধ্যে ছোট আমানতকারী এবং বেসরকারি খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি আমানত বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ যাবে বেসরকারি ব্যাংকে। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে যেসব ব্যাংকের অবস্থা ভালো স্বাভাবিকভাবেই সেসব ব্যাংক নির্বাচন করতে চাইবে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ। দুর্বল ও সঙ্কটে থাকা ব্যাংকে অর্থ রেখে কোনো সরকারি আমলা ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। ফলে সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো আদৌ সরকারি আমানত পাবে কি না সেই প্রশ্ন এসেছে।

এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে যেসব ব্যাংক ভালো অবস্থানে রয়েছে তারাই বেশি আমানত টানতে পারবে। সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো আরো পিছিয়ে পড়বে। একই সঙ্গে সরকারি আমানত পেতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে ব্যাংকগুলোর মধ্যে।

সূত্র বলছে, প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংকসহ ১০ থেকে ১২টি ব্যাংক মূলত তারল্য সঙ্কটে রয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট নেই। কিন্তু সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলোর প্রভাব গিয়ে আক্রান্ত করছে অন্য ব্যাংকগুলো।

ব্যাংকিং খাতের তারল্য সঙ্কট দূর করতে নগদ জমার হার (সিআরআর) পুনর্নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নতুন সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাপ্তাহিক ভিত্তিতে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং দৈনিক ভিত্তিতে ৫ শতাংশ হারে নগদ জমা সংরক্ষণ করতে হবে। এতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আমানত বাড়লেও এখানেও প্রথম সারির ব্যাংকগুলো বেশি অর্থ বের করতে পারবে।

জানতে চাইলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, সহসাই ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে না। কারণ রাতারাতি আমরা সরকারি আমানত পাব না। সরকারি আমানতগুলো বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা আছে। সেগুলো রাতারাতি মেয়াদপূর্ণ হবে না। ফলে এসব আমানত পেতে সময় লাগবে।

কিন্তু এসব আমানত সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো আদৌ পাবে কি না প্রশ্নে বলেন, এ ব্যাপারে আমি মন্তব্য করতে চাই না। এটি সবার কাছেই স্পষ্ট। কোনো আমানতকারী তার অর্থ ঝুঁকিতে ফেলতে চান না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, কোনো ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীর আস্থায় চিড় ধরলে তা ফেরানো কঠিন।
অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে পুরো অর্থনীতিতে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এটি আদৌ কাটবে কি না, নাকি ভবিষ্যতে আরো গভীর হবে সেটি চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে।

ব্যাংকিং খাতে সঙ্কট দূর না হলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে। ঋণ ও আমানতে যে নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে তা শৃঙ্খলায় ফিরবে না। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এমনিতে নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগ বাড়াতে চান না বেশির ভাগ ব্যবসায়ী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার ব্যাংকের মালিকদের ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে নতুন করে তাগিদ দিয়েছেন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের জন্য অনুদানের চেক গ্রহণকালে তিনি এ তাগিদ দেন।

জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইউনুসুর রহমান বলেন, ৫৭টি ব্যাংক মিলে পুরো ব্যাংকিং খাত। এখানে সরকারের মনোভাব খুবই স্পষ্ট। কোনো ব্যাংক সঙ্কটে পড়ে পুরো ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি তৈরি করুক সেটি আমরা চাই না। যেসব ব্যাংক সমস্যায় আছে তারা যাতে দ্রুত সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সেই চেষ্টাই সরকার করছে।