ব্লগার হত্যার তদন্তে কেন ধীরগতি?
এলজিবিটি অধিকার কর্মী জুলহাস মান্নান ও তাঁর বন্ধু, নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যায় জড়িত সন্দেহে আরো একজনকে পুলিশ আটক করেছে৷ কিন্তু এই মামলা এবং কাছাকাছি সময়ে জঙ্গি হামলায় নিহত অনেক মামলারই কোনো অগ্রগতি নেই৷
বুধবার আসাদুল্লাহ নামে যে একজনকে টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে সরাসরি জুলহাস-তনয় হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল বলে পুলিশের দাবি৷ সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার প্রশিক্ষক ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ৷ ২০১৬ সালে উত্তর বাড্ডায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সে সন্দেহভাজনদের একজন৷ পুলিশ জানায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেয়ার আগে আসাদুল্লাহ যশোরের নওয়াপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সদস্য ছিল৷
গত বছরের ২২ জুলাই এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে শেখ আবদুল্লাহ, ওরফে জুবায়ের নামে আনসার আল ইসলাম (এবিটি)-র এক শুরা সদস্যকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ এ নিয়ে মোট চারজনকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও মামলার তদন্ত কবে শেষ হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ৷
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার বাসায় ঢুকে জুলহাস ও তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হওয়ার পর থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কমপক্ষে ১০ জন ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও ভিন্ন চিন্তার মানুষকে হত্যা করা হয়৷ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পিছনেই কোনো-না-কোনো জঙ্গি সংগঠন চড়িত বলে পুলিশ বিভিন্ন সময় জানিয়েছে৷
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্লবীতে হত্যা করা হয় ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দারকে৷ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার শেষে রায় দেয়া হয়েছে৷
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির উল্টো দিকে হত্যা করা হয় বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়কে৷ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো চলছে৷ অভিজিতের পরিবার এরইমধ্যে কয়েকবার তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে৷
একই বছরের ১২ মে সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ এবং ৭ আগস্ট ঢাকার গোড়ানে নিজ বাসায় হত্যা করা হয় ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয়কে৷
এই হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনোটিরই তদন্ত শেষ হয়নি৷ কবে শেষ হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই৷
ওই বছরের ৩০ মার্চ ঢাকার তেজগাঁ এলাকায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয়৷ এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিয়েছে৷
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফীন দীপনকে হত্যা করা হয়৷ তিনি ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন৷ একই সময়ে লালমাটিয়ায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা৷ এই দু’টি ঘটনার কোনোটিরই তদন্তে অগ্রগতি নেই৷
২০১৬ সালের এপ্রিলে ঢাকায় হত্যা করা হয় অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমউদ্দিন সামাদকে৷ এই মামলার তদন্তেও অগ্রগতি নেই৷
গত বছরের ১১ জুন মুন্সিগঞ্জের সিরজদিখানে হত্যা করা হয় মুক্তমনা লেখক ও বিশাখা প্রকাশনীর মালিক শাহজাহান বাচ্চুকে৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ব্লগার ও মুক্তচিন্তার লেখকদের হত্যার পর দু-একটি মামলার তদন্তে আমরা অগ্রগতির খবর পেয়েছি৷ কিন্তু বাকি মামলাগুলোর তদন্তে আমরা ধীর গতি লক্ষ্য করছি৷ আমার কাছে মনে হয়েছে, তদন্তে কোনো একটা কিছু আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে৷ তদন্তকারী সংস্থাগুলো কাজ করছে৷ আমার ধারণা তারা তথ্যও পাচ্ছেন৷ কিন্তু তারা কৌশল হিসেবে আমাদের তথ্য জানতে দিচ্ছেন না৷ হতে পারে তদন্তের স্বার্থে তারা এটা করছেন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেখছি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দু-একজন ধরা পড়লেও তারা ক্রস ফরারে যাচ্ছে৷ এটা গ্রহণযোগ্য নয়৷ তাতে আমরা আরো অনেক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি৷ আর এটা আইনের পরিপন্থি৷ কেউ কেউ বলছেন, আসামিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়৷ আমার কথা হলো, তদন্ত সঠিক এবং তথ্য-প্রমাণভিত্তিক হলে আসামি ছাড়া পাবে না৷’’
তবে ঢাকা মেট্রোপলিন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তদন্তে অবহেলা বা ধীরগতি আমরা বলতে পারি না৷ কারণ, প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই শুরুতে ছিল ক্লুলেস৷ আর আমাদের কাছে এটা ছিল নতুন পরিস্থিতি৷ কিন্তু আমাদের কাছে এখন বিষয়টি পরিষ্কার এবং এইসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিদের কয়েকটি সংগঠন জড়িত৷ আনসার আল ইসলাম, নব্য জেএমবিসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে৷ এখন আমরা সুনির্দিষ্টভাবে দায়ীদের চিহ্নিত করছি৷ আমরা কয়েকটি মামলা ডিটেক্ট করেছি৷ তবে সমস্যা হলো, এইসব জঙ্গি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের একাধিক ছদ্ম নাম এবং তারা মোটিভেটেড, ফলে তাদের আইনের আওতায় আনতে কিছুটা সময় লাগছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তদন্তের মূল কাজ হয়ে গেছে৷ আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, এসব হতাকাণ্ডের পিছনে কারা, তাদের উদ্দেশ্য কী৷ এখন তাদের আইনের আওতায় আনতে খুব বেশি সময় লাগবে না৷’’
মাসুদুর রহমান আরো বলেন, ‘‘হোলি আর্টিজানের পর আমরা জঙ্গিদের মূল শক্তি ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছি৷ আশা করি তারা আর মাথাচাড়া দিতে পারবে না৷ আমরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি না৷ আমাদের জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত আছে৷’’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন