ভিডিও ফুটেজের ব্যাখ্যা নেই ফরহাদ মজহারের কাছে

কথিত অপহরণের দিন খুলনায় ফরহাদ মজহারের কার্যকলাপ নিয়ে ফাঁস হওয়া দুই ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ফুটেজের কোনো ব্যাখ্যা ফরহাদ মজহার দিতে পারেননি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি পুলিশকে বলেন, ঘটনার সঠিক তদন্ত করার।

‘অপহরণ কাণ্ডের’ ১৫ দিন পর মঙ্গলবার ফরহাদ মজহারকে দ্বিতীয় দফায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডাকা হয়। তিনি আসেন তার সঙ্গীনি ফরিদা আখতারকে নিয়েই। দুপুরের আগে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে ঢুকেন তারা, বেরিয়ে যান বেলা দেড়টার দিকে। সব মিলিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় দুই ঘণ্টারও বেশি।

গত ৩ জুলাই শ্যামলীর বাসা থেকে বের হওয়ার পর ফরহাদ মজহারকে অপহরণের অভিযোগ করেছিল তার পরিবার। তারা জানায়, ফরহাদ ফোন করে তার সঙ্গীতি ফরিদা আখতারকে জানিয়েছেন, অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে। আর পুলিশ এই মুঠোফোন ট্র্যাক করে ফরহাদ মজহারের অবস্থান খুলনায় শনাক্ত করে।

খুলনায় দুই এলাকায় অভিযান চালালেও তার আগেই সেখান থেকে চলে যান ফরহাদ মজহার। পরে রাতে খুলনা থেকে হানিফ পরিবহনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে করে ঢাকায় ফেরার পথে যশোরের অভয়নগরে উদ্ধার হন ফরহাদ মজহার।

পরদিন ভোরে এই কবি ও প্রাবন্ধিককে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। প্রথমে আদাবর থানা এবং পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ের নিয়ে আসা হয় তাকে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে ফরহাদ দাবি করেন, ভোরে তিনি ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজন তাকে জোর করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর সন্ধ্যা সাতটার দিকে খুলনায় একটি বাসের টিকিট হাতে ধরিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এরপর আদালতে গিয়ে একই জবানবন্দি দেন গুম, খুন নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে সোচ্চার এই রাজনৈতিক ভাষ্যকার। আর আদালত নিজ জিম্মায় মুক্তি দেয় তাকে। আর তিনি রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন।

এরই মধ্যে ফরহাদ মজহার ‘অপহরণ’ ইস্যু আলোড়ন তুলে দেশ জুড়ে। বিএনপি দাবি করে, সরকার তার বাহিনী দিয়ে আলোচিত তাকে তুলে নিয়েছে।

এরই মধ্যে শুরু হয় তদন্ত। আর ফরহাদ মজহারের বক্তব্য ও প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাকের কথা জানায় পুলিশ। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয় একটি ভিডিও। খুলনা নিউমার্কেটের সিসি ক্যামেরার ধারণ করা ফুটেজে দেখা যায়, ফরহাদ মজহার সেখানে শান্তভাবে ঢুকেছেন বেলা ৪.৪১ মিনিটে। তার পরনে ছিল চেক লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবী এবং মাথায় পাগড়ী।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ফরহাদ মজহার নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারের প্রবেশ মুখ দিয়ে প্রবেশ করেন। বিকেল পাঁচটা ১৭ মিনিটে তাকে একই জায়গায় পায়চারী করতে দেখা যায়। এসময় নিজেকে আড়াল করার চেষ্টাও করেন তিনি। এসময় তার কাঁধে ঝোলানো ছিল সাদা রঙের ব্যাগ।

১৩ জুলাই পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক সংবাদ সম্মেলন করে কথিত এই অপহরণ মামলার তদন্তের বিস্তারিত প্রকাশ করেন। বলেন, ফরহাদ মজহার অপহৃত হননি। তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছিলেন। এক নারীর সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং এর জেরে তিনি দুইবার গর্ভধারণ করেন। কিন্তু দুইবারই তার গর্ভপাত করানো হয়।

এই নারীর জন্যই টাকা যোগাড় করতেই ফরহাদ মজহার সেদিন বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বলে দাবি করেন আইজিপি। জানান, সেদিন সন্ধ্যায় খুলনার একটি দোকান থেকে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে দুই দফায় ওই নারীকে ১৫ হাজার টাকা পাঠান তিনি। ওই দিনই ওই দোকানে ফরহাদ মজহারের টাকা গুনে গুনে ব্যাগ থেকে বের করার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়।

এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন ফরহাদ মজহার। কিন্তু তিনি প্রকাশিত এই ভিডিও এবং পুলিশের দাবি নিয়ে মুখ খুলেননি। তার স্বজনরাও গণমাধ্যমের সামনে আসতে রাজি হননি। যদিও হাসপাতালে থাকার সময় ফরহাদ মজহার একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি চুপ থাকবেন না, তার সঙ্গে কী হয়েছে সেটা প্রকাশ্যে বলবেন।

ফরহাদ সংবাদ সম্মেলন করবেন, জানিয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠজনেরাও। কিন্তু বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর এর কিছুই আর বাস্তব হয়নি। সাংবাদিকদের ফোনও ধরছেন না ফরহাদ বা তার স্বজন বা ঘনিষ্ঠজনরা। এর মধ্যে ডিএমপির গোয়েন্দা কার্যালয়ে ফরহাদ মজহারকে দ্বিতীয় দফায় ডেকে পাঠানো হয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে ফরহাদকে দুটি ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে আদালতের জবানবন্দির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তবে এক পর্যায়ে বলেছেন, ‘ঘটনার সঠিক তদন্ত করা হোক। এর বাইরে আরও কিছু থাকলে তা যেন তদন্ত করা হয়।’

ফরহাদ মজহার আজ কী বলেছেন-জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা যুগ্ম-কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, ‘ফরহাদ মজহার ১৬৪ ধারায় আগে অপহরণ বিষয়ে যেসব তথ্য দিয়েছিলেন তা-ই পুনরায় আজ জানিয়েছেন। অপহরণ বিষয়ে অন্য কোনো তথ্য থাকলে তার সঠিক তদন্তও দাবি করেছেন। মামলাটির সব বিষয় নিবিড়ভাবে তদন্ত করে দেখছি।’

ফরহাদ মজহারের আগের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব তথ্যের গড়মিল হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না-জানতে চাইলে আবদুল বাতেন বলেন, ‘তিনি অসত্য তথ্য দিলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্ত্রী ফরিদা আখতার ফরহাদ মজহার ডিবি কার্যালয়ে আসেন। ফরহাদ মজহারের কাছে অপহরণ সংক্রান্ত তথ্য পুনরায় জানতে চাই। উদ্ধার করা ভিডিও ফুটেজ ও কললিস্ট ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে তিনি কিছু না বলে আগের তথ্যই পুনরাবৃত্তি করেন। বলেন, এর বাইরে তিনি কিছু জানেন না।’

ফরহাদ মজহার বাসায় ফেরার পর তার প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল জব্বারের সঙ্গেও কথা হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। তিনিও বলেছেন, ফরহাদ মজহার সঠিক তদন্ত দাবি করেছেন। আগে তিনি যে তথ্য আদালতে দিয়েছেন তাই পুনরাবৃত্তি করেছেন।প্রতিবেদন ঢাকাটাইমসের সৌজন্যে প্রকাশিত।

https://youtu.be/DbovE4i_gyA


https://youtu.be/IC0xSu8KOQQ