‘ভুঁইফোড়’ অনলাইনের বিরুদ্ধে কারা, কীভাবে ব্যবস্থা নেবে?
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তাঁর কর্মদিবসের প্রথম দিনেই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ‘ভুঁইফোড়’ অনলাইনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানান৷ প্রশ্ন উঠেছে, ‘ভুঁইফোড়’ কীভাবে চিহ্নিত করা হবে? আর ব্যবস্থা কারা,কিভাবে নেবে?
তথ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার ‘ভুঁইফোড়’ অনলাইনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলতে গিয়ে এর প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করেছেন৷ তিনি বলেছেন,‘‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক হারে ইন্টারনেট গ্রাহক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তাও বেড়েছে৷ এই সুযোগে তৈরি হয়েছে অনেক ভূঁইফোড় অনলাইন সংবাদমাধ্যম৷ অনেকে ফেসবুকে বিভিন্ন মনগড়া খবরও ছড়াচ্ছে৷ ভুল তথ্য পরিবেশন করায় অনেকের চরিত্র হননের ঘটনাও ঘটে৷ তাই এসব অনলাইন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷’’
তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে অনলাইন মিডিয়ার ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে৷ এটা শেখ হাসিনার হাত ধরেই হয়েছে৷ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই অনেকগুলো বেসরকারি টেলিভিশনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই প্রধানমন্ত্রী দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন৷’’
নির্বাচনের আগে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন(বিটিআরসি) নিউজ পোর্টালসহ ৫৮টি অনলাইন বন্ধ করে দেয়৷ বন্ধের একদিন পর আবার সবগুলো খুলে দিয়ে ৫৪টি আবার বন্ধ করে দেয়া হয়৷ অর্থাৎক ৫৮টি থেকে চারটি নিউজ পোর্টাল খোলা থাকে৷ এগুলো হলো: ঢাকাটাইমস, রাইজিংবিডি, পরিবর্তন ও প্রিয়ডটকম৷ তবে এই অনলাইনগুলো কেন বন্ধ করা হলো আর কেনইবা পরে আবার চারটি খুলে দেয়া হলো তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি বিটিআরসি৷
বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন নিউজ পোর্টালের অনুমোদন দেয়ার কোনো পদ্ধতি এখনো নেই৷ তবে অনলাইন ও সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে৷ অনলাইনগুলো ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে তাদের কাজ চালাচ্ছে৷ তথ্য মন্ত্রনালয় অবশ্য অনুমোদন দেয়ার জন্য প্রায় দুই বছর আগে অললাইনগুলোর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট ফরমে আবেদন আহ্বান করেছিল৷ গত বছরের জানুয়ারি মাসে তখনকার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংসদে জানিয়েছিলেন, নিবন্ধনের জন্য দুই হাজার ১৮টি অনলাইন আবেদন করেছে৷ কিন্তু বাস্তবে কতটি অনলাইন আছে তার কোনো হিসাব তথ্য মন্ত্রনালয়ের কাছে নেই৷
নিবন্ধনের জন্য তথ্যমন্ত্রনালয়ে আবেদন করেছেন এরকম কয়েকটি অনলাইনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, আবেদনের পর তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে একটি প্রতিনিধি দল তাদের অফিস পরিদর্শন এবং অবকাঠামোগত অবস্থা দেখে গেছেন৷ পুলিশ তথ্য যাচাইয়ের কাজও করেছে৷ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও নিয়ে গেছে৷ কিন্তু এরপর আর কোনো খবর নেই৷ নিবন্ধন দেয়ার বিষয়টি ঝুলে আছে৷ নিবন্ধন না দেয়ায় সরকার চাইলে যে-কোনো অনলাইন যে-কোনো সময় বন্ধ করে দিতে পারে৷ তাছাড়া ওই অনলাইনগুলো এখন সরকারি বিজ্ঞাপনও পাচ্ছে না৷
গত অক্টোবরে মন্ত্রিসভা ‘সম্প্রচার আইন-২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা৷ আর তাতে বলা হয়, সম্প্রচার নীতিমালার আওতায় একটি কমিশন গঠন করা হবে৷ ঐ কমিশন হবে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, যার গঠন হবে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে৷ কমিশন গঠন করতে হবে ৭ সদস্যের, যার মধ্যে একজন নারীও থাকবেন৷
এ কমিশন সম্প্রচার যন্ত্রপাতির লাইসেন্স দেবে৷ অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের একক কর্তৃত্ব থাকবে৷ কমিশনের কাজ হবে সম্প্রচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করা৷ এছাড়া বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের নতুন লাইসেন্সের অনুমোদন দেয়া হবে কিনা, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া৷ একই সঙ্গে একটি অনলাইন নীতিমালা ও সম্প্রচার নীতিমালারও খসড়া করা হয়েছে৷ এই নীতিমালা নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা রয়েছে৷
বাংলাদেশে এখন অনলাইন গণমাধ্যম ওইসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী চলছে৷ আর নীতিমালা ও নিবন্ধন না থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছে সরকার৷
তাই তথ্যমন্ত্রী যে বলেছেন ‘ভুঁইফোড়’ অনলাইনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় হবে সেটা কিভাবে নেয়া হবে এই প্রশ্ন উঠেছে৷ আর সেটা তথ্য মন্ত্রণালয় নিতে পারবে কিনা তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ৷
অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলাডটনেট এবং জিটিভি’র প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি হঠাৎ করেই তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যে হতাশ হয়েছি৷ প্রথমত আমরা অনেক দিন ধরেই অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য একটি নীতিমালা চেয়ে আসছি৷ আমরা আশা করেছিলাম এই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার ব্যাপারে তিনি কথা বলবেন৷ দ্বিতীয়ত, সরকার একটি গণমাধ্যমকর্মী আইন করতে যাচ্ছে৷ তাঁর উচিত ছিল সেই গণমাধ্যমকর্মী আইনে অনলাইনকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা দেখে কথা বলা৷ সব দেখে তিনি একটা সার্বিক কথা বলতে পারতেন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা জানি, অনেক অনলাইনে অনেক সমস্যা আছে৷ কোনোটা পেশাদারিত্বের সাথে চলছে, কোনোটা চলছে না৷ কোনোটা এক ব্যক্তিনির্ভর, কোনোটা একটি ল্যাপটপনির্ভর৷ তিনি যে ‘ভুঁইফোড়’-এর কথা বলেছেন তার সংজ্ঞা কী? সুতরাং আগে ভুঁইফোড়-এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন৷ তারপরে তাঁর বলাটা যৌক্তিক হতে পারত৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এক ধরনের শঙ্কা তো তৈরি হয়েছে৷ নির্বাচনের আগে কতগুলো অনলাইন বন্ধ করে দেয়া হলো৷ আবার পরে কিছু বন্ধ রেখে কিছু খুলে দেয়া হলো৷ এসব ঘটনায় আমার কাছে মনে হয়েছে এমন একটা নির্দেশনা দেয় যে, আমরা আসলে কোনো সিস্টেমের মধ্যে থাকছি না৷ আমার কথা হলো, তিনি (তথ্যমন্ত্রী) যেটা বলেছেন তা যদি বাস্তবায়ন করতে চান তার আগে এর স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, অনলাইন নীতিমালা চূড়ান্ত করতে হবে৷’’
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মন্ত্রী মহোদয় যে ভুঁইফোড় অনলাইন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ কথা৷ অনেক দিন ধরেই এটা নিয়ে কথা হচ্ছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে নেবেন? অনলাইন নীতিমালার কথা বলা হচ্ছে৷ সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় যে সম্প্রচার আইন অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেখানে জাতীয় সম্প্রচার কমিশনের কথা বলা হয়েছে৷ এই কমিশনটা এখন গঠন করা জরুরি৷ তারাই কেবল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং যাচাই-বাছাই করে অনলাইন অনুমোদন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে৷ কিছু অনলাইনের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর পরিবেশনের অভিযোগ আছে৷ সেগুলোর বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, তেমনি যারা পেশাদারিত্বের সাথে খবর পরিবেশন করে, তারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা-ও দেখতে হবে৷’’
এই ধরনের অভিযোগ তো কিছু পত্রিকা বা টেলিভিশনের বিরুদ্ধেও রয়েছে৷ তাহলে ব্যবস্থা কী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় নেবে, না স্বাধীন কোনো কমিশন নেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রচার মাধ্যম এবং অনলাইনের বিরুদ্ধে যদি কোনো ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তা সম্প্রচার কমিশনের মাধ্যমে এবং পত্রিকার বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে তা করা উচিত৷ অন্যথায় জনমনে ধারণা হতে পারে যে, সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক হয়ে উঠছে৷’’-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন