ভুল বার্তাই দিলেন সিইসি
সোহরাব হাসান : প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা নির্বাচনের লক্ষ্যে যে সাত দফার পথনকশা তৈরি করেছেন, তার সফলতা-বিফলতা নির্ভর করছে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আচরণের ওপর। এতে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার; নির্বাচন-প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ, জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, বিধি অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
গতকাল রোববার পথনকশা ঘোষণাকালে সিইসি আরও বলেছেন, এ কর্মপরিকল্পনা নির্বাচনের পথে কাজ শুরুর একটি সূচনা দলিল। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে এটি আরও বাস্তবায়নযোগ্য করে তোলা হবে। তাঁর এই সদিচ্ছাকে আমরা স্বাগত জানাই।
পথনকশা অনুযায়ী সুশীল সমাজের সঙ্গে ৩১ জুলাই, গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আগস্টে, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক, নারীনেত্রী ও নির্বাচন পরিচালনাকারী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অক্টোবর মাসে পৃথক দিনে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সংলাপে পাওয়া সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করা হবে ডিসেম্বরে।
কিন্তু সিইসি সেই অনুষ্ঠানে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা হতাশাজনক। তাঁর এই বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে সংশয় আছে, তা আরও বাড়াতে পারে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন করা। আর নির্বাচন বলতে অবশ্যই সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন বোঝায়, যাতে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, সেই পরিবেশটি কমিশন কখন করবে? সিইসির মতে, তফসিল ঘোষণার আগে তাঁদের কিছু করার নেই। সত্যিই কি করার নেই? তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের যদি কিছু করার না থাকে, তাহলে তো তিন মাসের জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই হতো। ওই তফসিলের আগে নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবেন না। কোনো তৎপরতা চালাবেন না। সিইসি মহোদয় নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। তাঁর পথনকশাই বলে দিচ্ছে, আগামী দেড় বছর ধরেই কমিশন নির্বাচনসংক্রান্ত কাজগুলো করে যাবে। এর মধ্যে সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, রাজনৈতিক দলের জবাবদিহির সঙ্গে রাজনৈতিক দল বা পক্ষগুলো সরাসরি জড়িত। সিইসির জানার কথা যে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে যত হাঙ্গামা হয়েছে, তা শুধু তফসিল ঘোষণার পর হয়নি। এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে বিদায় নিতে হয়েছিল ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরির দায় নিয়ে। এম এ সাদেকের কমিশন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করলেও সেই সংসদের আয়ু ছিল মাত্র কয়েক দিন। রকিব কমিশন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্বাচন করলেও নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কেবল বিএনপির বর্জনের কারণে নয়, নির্বাচন কমিশনের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণেও।
সংবিধানের ১১৮(১) ধারায় আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করিবেন, সেই রূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষ রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’
আর ১১৯(১) ধারায় আছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্যদের নির্বাচন পরিচালনা করিবেন।’
এখন নির্বাচন-সহায়ক পরিবেশ আছে বলে মনে করেন কি না, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এগুলো নির্বাচন কমিশনের বিষয় নয়। এটি সরকারের বিষয়। কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়, কমিশন শুধু সেটা নিয়ে ভাবে। তফসিল ঘোষণার পর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজ আইনে নির্ধারণ করা আছে। এ মুহূর্তে সরকারের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কমিশনের নেই। রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশ বা মিছিল-মিটিং করার অধিকার না পেলে তাতেও নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। তফসিল ঘোষণার পর এসব দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।
নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা হয় পাঁচ বছরের জন্য। অতএব এই সময়ে নির্বাচনসংক্রান্ত যেসব কাজ, যেমন: ভোটার তালিকা হালনাগাদ, রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি ইত্যাদি আদায় সবকিছুই কমিশনকে করতে হবে। তারা যে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংলাপ ইত্যাদি করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তাও তো নির্বাচনী আইনে লেখা নেই। নির্বাচনী আইনে আছে, নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে এবং নির্বাচন পরিচালনা করবেন। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তারা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি আদায় করতে পারে, সরকারকে কেন বলতে পারবে না নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে।
বর্তমান সিইসি ও তাঁর সহযোগীদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সরকারকে বলতে না পারার জন্যই এ দেশে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সিইসি যখন এই আস্থা ব্যক্ত করছেন যে বর্তমান সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তখন তিনি কেন তাদের আচরণবিধি মেনে চলার কথা বলতে পারবেন না? সিইসি হিসেবে তফসিল ঘোষণার আগে তিনি সরকারপ্রধানকে কিছু বলতে না পারলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রধানকে তো বলতে পারেন।
কিন্তু সেদিকে না গিয়ে সিইসি দেশবাসীকে ভুল বার্তাই দিয়েছেন। এর পরিণতি কী, তিনি বা তাঁর সহযোগীরা ভেবে দেখেছেন? জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমা করে। অতীতের ভুল স্বীকার করলে তাদের ভোটও দেয়। কিন্তু সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে যাঁরা সেই শপথ ভঙ্গ করেন, তাঁদের ক্ষমা করে না। আর তার একাধিক উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে আছে। -প্রথম আলো থেকে নেওয়া
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন