শাস্তির মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছেন সেই এমপি-মন্ত্রীরা
ভেঙে পড়েছে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড
শাস্তির মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছেন সেই এমপি-মন্ত্রীরা। তাঁরা দলীয় সভানেত্রীর কড়া নির্দেশনার পরও সন্তান, আত্মীয়স্বজনদের উপজেলা নির্বাচন থেকে বিরত রাখেননি। ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন।
রাজনীতি-বিশ্লেষকরা বলছেন, টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের দলীয় চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। এমপি-মন্ত্রী এমনকি কিছু কেন্দ্রীয় নেতাও দলীয় প্রধানের নির্দেশনা মানেননি। এটা সংগঠনবিরোধী কার্যক্রম। শৃঙ্খলা-পরিপন্থি কাজ। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করলে বহিষ্কারসহ নানা শাস্তির কথা গঠনতন্ত্রে রয়েছে। এর আগে একাধিকবার গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অপরাধে কাউকে কাউকে বহিষ্কার করা হলেও পরে আবার সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন। দলীয় পদপদবি এমনকি মনোনয়নও দেওয়া হয়েছে তাদের।
সে কারণে এবারের উপজেলা নির্বাচনেও দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা আমলে নেননি অনেক এমপি-মন্ত্রী। প্রথম ধাপের ভোটে গত সোমবার ছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। শেষ দিনেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনরা। এসব প্রার্থীর বিষয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, যারা দলীয় নির্দেশ অমান্য করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তারা মূলত দলের শৃঙ্খলা মেনে চলছেন না। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অমান্য করছেন। তাদের বিষয়ে দল অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলীয় নির্দেশ অমান্যকারীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনীন করার জন্য দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি-মন্ত্রীদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ চাপ এখনো বহাল রয়েছে। প্রথম ধাপের ভোটে কিছু এমপি-মন্ত্রী দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা রেখেছেন। কেউ কেউ রাখেননি। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি।
আশা করি তারা দলীয় প্রধানের কথা রাখবেন। যারা দলীয় সভানেত্রীর কথা রাখেননি, তাদের ব্যাপারে ৩০ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।’ জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করার পেছনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিজের পক্ষে নানা যুক্তিও দিচ্ছেন। প্রথম ধাপের নির্বাচনে দলের নির্দেশনা এসেছে ১৮ এপ্রিল। আর প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ১৫ এপ্রিল।
এজন্য কোথাও কোথাও মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা একমাত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী কিংবা আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হয়ে গেছেন। তাদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও নেই। স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেদের স্বজনদের প্রার্থী ঘোষণা করায় অন্যরা আর প্রার্থী হওয়ার সাহস পাননি। প্রথম ধাপের ভোটে অনেক এমপি-মন্ত্রী দলীয় সভানেত্রীর কথা তো শোনেনইনি, দ্বিতীয় ধাপেও এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে দেনদরবার শুরু করেছেন কেউ কেউ। দ্বিতীয় ধাপে কুমিল্লা সদর আসনে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন কুমিল্লা-১০ আসনের এমপি, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই গোলাম সারোয়ার।
আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে এসেছিলেন তাঁর ভাইয়ের পক্ষে দলীয় নেতা-কর্মীকে কাজ করতে যেন কুমিল্লা সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহারউদ্দিন বাহারকে ফোন করেন। এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক সরাসরি না করে দেন। একই সঙ্গে দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা মানার কথা বলেন সাবেক অর্থমন্ত্রীকে। সুনামগঞ্জ-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ সাদিকের ভাগনে ফজলে রাব্বী স্বরনও সদর আসনে প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছেন।
প্রথম ধাপে যেসব এমপি-মন্ত্রীর স্বজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান এবং চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান (শফিক) খান মাদারীপুর সদর উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও টাঙ্গাইল-১ আসনের এমপি ড. আবদুুর রাজ্জাকের দুই স্বজন তাঁর নির্বাচনি এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আবদুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুন অর রশিদ হীরা ও মামাতো ভাই মো. মঞ্জুরুল ইসলাম তপন ধনবাড়ী উপজেলায় নির্বাচনি মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্তে অটল আছেন।
শেষ দিনেও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী আতাউর রহমান আতা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। আতা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই। গাজীপুর-১ আসনের এমপি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের আপন ভাতিজা পরিচয় দেওয়া মুরাদ কবীর গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদ থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। তবে মোজাম্মেল হক বলেছেন, মুরাদ তার আপন ভাতিজা নন, দূর সম্পর্কের ভাতিজা।
বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন ও পাশের সোনাতলা উপজেলায় তাঁর ভাই মিনহাদুজ্জামান উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দিনাজপুর-৫ আসনের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের ছোট ভাই উপজেলা নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি মাজহারুল ইসলাম সুজনের চাচা মোহাম্মদ আলী, চাচাতো ভাই আলী আফসার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি।
পাবনার বেড়া উপজেলায় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ভাই সাবেক বেড়া পৌর মেয়র আবদুল বাতেন। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের ভাগনে জাহাঙ্গীর হোসেন সোহেল নির্বাচন করছেন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় বর্তমান এমপি আলী আজগর টগরের পরিবারের দুজন অংশ নিচ্ছেন। এঁরা হলেন ভাই আলী মুনছুর বাবু এবং তাঁদের চাচা সহিদুল ইসলাম। নীলফামারী-১ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন সরকারের চাচাতো ভাই আনোয়ারুল হক সরকার মিন্টু ও ভাতিজা ফেরদৌস পারভেজ নির্বাচন করছেন।
নেত্রকোনা-১ আসনের এমপি মোশতাক আহমেদ রুহির চাচাতো ভাই মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান কলমাকান্দা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। মানিকগঞ্জ-৩ (মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলা) আসনের এমপি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আপন ফুপাতো ভাই মো. ইসরাফিল হোসেন রয়েছেন নির্বাচনে। প্রথম ধাপে নরসিংদীর পলাশ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি আলহাজ শরীফুল হক। সম্পর্কে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের স্ত্রীর বড় ভাই।
মৌলভীবাজার-১ আসনের এমপি ও সাবেক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের ভাগনে শোয়েব আহমদ বড়লেখা উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। নোয়াখালী-৬ আসনের এমপি মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী অমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মাঠে থাকলেন সাবেক মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী ও পিরোজপুরে-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই এস এম নুরে আলম সিদ্দিকী।
নোয়াখালী ৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর একমাত্র ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলীয় সভানেত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেখানে অনেকের বোধোদয় হয়নি। শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। যারা দলীয় প্রধানের নির্দেশনা মানেন না, জনগণও তাদের সেভাবেই মূল্যায়ন করবে। ৩০ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা না মানা অত্যন্ত দুঃখজনক। দলীয় ফোরামে আলোচনা করেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন