ভেষজরাজ বা ভৃঙ্গরাজের ভেষজ গুণাবলি ও ব্যবহার
ভৃঙ্গরাজ নামটির সাথে বাংলাদেশের মানুষ বহুকাল থেকেই পরিচিতি।”ভেষজের রাজা’ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ভৃঙ্গরাজ একটি আয়ুর্বেদিক ঔষধি যা বিশেষ করে চুলের বৃদ্ধি ঘটনার জন্য দারুণ উপকারী
বাংলা বা স্থানীয় নাম : ভৃঙ্গরাজ, কেশরাজ, ভিমরাজ
ইউনানী নাম : ভাংরা
আয়ুর্বেদিক বা কবিরাজী নাম : ভৃঙ্গরাজ
ইংরেজী নাম : Bringa Raj
বৈজ্ঞানিক নাম : Wedelia chinensis (Osb.) Merr.
পরিবার : Asteraceae
গোত্র : Compositae
উদ্ভিদ পরিচিতি :
হালকা কষস্বাদযুক্ত ও কটু তিক্ত ভেষজ উদ্ভিদ ভৃঙ্গরাজ। এর চকচকে সবুজ পাতার আড়ালে ফোটে ছোট্ট ছোট্ট হলুদ ফুল। দেখতে অনেকটা সূর্যমুখী ফুলের মতো।ভৃঙ্গরাজ সূক্ষ্ম লোমযুক্ত বহুবর্ষজীবী ছোট বীরৎ। কান্ড ১৫-২০ সে.মি. লম্বা হয়। গীষ্ম ও বর্ষাকালে ফুল ও ফল হয়।প্রাচীন কাল থেকেই ভৃঙ্গরাজের ভেষজ গুণাবলি গুরুত্ব অপরিসীম। পথের ধারে কিংবা বাড়ির সামনে সৌন্দর্য বাড়াতে এর জুড়ি নেই।
অনেকে এই ফুলের নামই জানেন না। খুব অযত্নেই বেড়ে ওঠে এই উদ্ভিদ। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, অযত্নে বেড়ে ওঠা এই উদ্ভিদটি আপনার এত উপকারে আসতে পারে? এই উদ্ভিতটি অনেক জটিল সমস্যা থেকে অনায়াসেই মুক্তি দিতে সক্ষম। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক এর উপকারিতা সম্পর্কে-
রাসায়নিক উপাদানঃ
এই উদ্ভিদে আছে উপক্ষার,স্যাপোনিন,
ট্যানিন,ফ্ল্যাভোনয়েড,একটি ল্যাকটোন,
ওয়েডেলোল্যাকটোন,এবং নর – ওয়েডিলিক অ্যাসিড।এই উদ্ভিদের রসে থাকে একটি তেলে দ্রবণীয় কালো ডাই,মোম জাতীয় যৌগ,ফাইটোস্টেরল,ক্যারোটিন এবং রজন।এই উদ্ভিদে আরো থাকে অজৈব লবণ,সিলিসাস বস্তু,পেকটিন এবং মিউসিন।
ব্যবহার্য অংশঃ পাতা, বীজ ও সম্পূর্ণ গাছের রস।
ধর্মাবলি ও ব্যাবহার :
এটি কাশি,ম্যাথা ব্যাথা, চর্মরোগ ও টাক পড়ার চিকিৎসায় এবং চূলের বৃদ্ধিতে দারুণ কার্যকর।চুল দীর্ঘ ও কালো করে, স্নায়ুবিক দুর্বলতায় ফলপ্রদ। বলকারক এর পাতা চুলপাকা রোধে ও চুলের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়।বর্ধিত যকৃত ও প্লীহার চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহার করা হয়।অতিরিক্ত রক্তস্রাব এবং মূত্রনালীর রক্তক্ষরণে এর জলীয় নির্যাস খুব কার্যকর।
রোগ প্রতিকার :
১. শিরোরোগে: সূর্যোদয়ের পর অনেকের মাথার যন্ত্রণা হয়, আবার কারও বা আধকপাল মাথাব্যথা হয়; সেক্ষেত্রে ভৃঙ্গরাজের নস্য নিলে বা মাথায় মাখলে এর উপশম হয়।
২. কেশপতনে বা চুল পড়া বন্ধ করতে: ভৃঙ্গরাজ বা
ভীমরাজ পাতার রস করে দুপুর বেলার দিকে
লাগতে হয়। এই পাতার রস দিয়ে তেল পাক করে লাগলেও কেশপতন বন্ধ হয়।
৩. মাথায় উকুন: এই পাতার রস মাথায় মাখলে উকুন মরে যায়।
৪. পোড়ার সাদা দাগে: এক্ষেত্রে ভৃঙ্গরাজ রস থেকে ও কেশুর্তের রসে দুবা বেটে লাগালে কয়েকদিনের মধ্যে গায়ের স্বাভাবিক রং ফিরে আসে।
৫. চোখ ওঠায়: পুজ পড়তে থাকলে ২০ থেকে ২৫ফোঁটা ভৃঙ্গরাজ রস জলে মিশিয়ে ঐ জলে চোখ ধুলে পুজ পড়া বন্ধ হয়।
৬. পায়োরিয়ায়: ভৃঙ্গরাজের পাতা চূর্ণ করে
মাজনের মতো ২ থেকে ৪ মিনিট মেজে মুখ ধুয়ে ফেলতে হয়। এর দ্বারা ঐ দোষটি সেরে যায়।
৭. পেটের সমস্যা: যাদের দাস্ত হতে চায় না,
তাঁদের এটি বিশেষ কার্যকরী হয়ে থাকে। তবে এটি দীর্ঘদিন ব্যবহার না করাই ভাল।
৮. পুরাতন আমাশায়: অজীর্ণ মল, আর সঙ্গে আমও আছে, মলের রংও ভাল নয়; সেক্ষেত্রে এর পাতার রস ২৫ থেকে ৩০ ফোঁটা প্রতিদিন আধ কাপ ছাগল দুধের সঙ্গে কয়েকদিন খেতে হয়।
৯. শোত্থে: সর্বশরীর অথবা হাত-পায়ে একটু ফোলা ফোলা ভাব, সেক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৩০ ফোঁটা এই পাতার রস দুধের সঙ্গে খেলে ও ভাবটা কেটে যায়।
১০. রক্তে শ্বেতকণিকা বেড়ে গেলে: এই পাতার রস উপরিউক্ত মাত্রায় দুধের সঙ্গে খেতে দিলে ওটি আবার স্বভাবে ফিরে আসে।
১১. চুল পড়া কেশপতনের বিশেষ ক্ষেত্র: যেসব মা শ্বেতপ্রদরের শিকার হয়েছেন, তাঁদের মাথার চুল প্রায় ক্ষেত্রেই উঠে যেতে থাকে। তাঁর ভৃঙ্গরাজের পাতা সিদ্ধ করে সেই জলে দিনে ২ বার মাথা ধুয়ে ফেলবেন, এর দ্বারা ৩৪ দিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল পাবেন।
১২. ক্রিমির উপদ্রবে: লম্বা বা ঝুরো কৃমি সব
বয়সের লোককেই ব্যতিব্যস্ত করে, সেক্ষেত্রে এই ভৃঙ্গরাজের পাতার রস ১ চা-চামচ(পুর্ণবয়স্কদের জন্য) সিকি কাপ জলে মিশিয়ে খেলে ওটির উপদ্রব কমে যায়।
১৩. দাদে: ভৃঙ্গরাজের রসের প্রলেপ দিলে বেশ কাজ হয়।
১৪. স্নায়ুবিক দুর্বলতা: ভৃঙ্গরাজের রস ২৫। ৩০ ফোঁটা প্ৰত্যহ সকালে মধু সহ খেলে স্নায়ুবল ফিরে আসে।
১৫.পান্ডুরোগ : কুলেখাড়ার পাতার রস না দিয়ে ভৃঙ্গরাজের পাতার রস খাওয়ালে আরও বেশি কাজ হয়।
১৬. পুরাতন জ্বর ও অজীর্ণে: যাঁরা এতে ভুগছেন,তাঁরা সকালে ও বিকালে ১ চা-চামচ মাত্রায় ভৃঙ্গরাঞ্জের পাতার রস খেয়ে দেখুন, এতে উপকার পাবেন।
১৭. দাঁতের মাড়ির দুর্বলতা: ভৃঙ্গরাজের পাতার গুড়ো দিয়ে দাঁত মাজলে মাড়ি শক্ত হয়।
১৮. মাড়িতে ঘা: ঘা থাকলে ঐ পাতার ক্বাথে
কয়েকদিন মুখ ধুলে সেরে যায়।
রোগ অনুযায়ী ব্যবহার পদ্ধতিঃ
রোগেরনামঃ বলকারক হিসেবে
ব্যবহার্য অংশঃ পাতার নির্যাস
মাত্রাঃ ১০-১২ মিলি
ব্যবহার পদ্ধতিঃ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দিনে ২ বার সেব্য।
রোগেরনামঃ চুলপাকা ও চুলপড়ায়
ব্যবহার্য অংশঃ পাতার রস
মাত্রাঃ পরিমানমত
ব্যবহার পদ্ধতিঃ চুলের গোড়ায় দিনে ২ বার লাগাতে হয়।
রোগেরনামঃ মাথা ব্যথায়
ব্যবহার্য অংশঃ পাতার রস
মাত্রাঃ পরিমানমত
ব্যবহার পদ্ধতিঃ চুলের গোড়ায় দিনে ২ বার লাগাতে হয়।
রোগেরনামঃ শোথে
ব্যবহার্য অংশঃ পাতার রস
মাত্রাঃ ২০-২৫ ফোঁটা
ব্যবহার পদ্ধতিঃ দুধের সঙ্গে দিনে ২-৩ বার সেব্য।
সতর্কতাঃ নির্দিষ্ট মাত্রা ও নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ব্যবহার করা অনুচিত।
তথ্যসূত্র :
১. চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য।
২.বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় গাছ-গাছড়া,ড. তপন কুমার দে।
৩.ভেষজ উদ্ভিদের কথা, প্রফেসর ড. নিশীথ কুমার পাল।
৪. লোকজ উদ্ভিদবিজ্ঞান,প্রফেসর ড. নিশীথ কুমার পাল।
৫.উদ্ভিদকোষ, শেখ সাদী।
লেখক : শিক্ষার্থী, অনার্স ২য় বর্ষ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন