ভোট নিয়ে ভারতে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা নীরব কেন?
ভারতের মুসলিম সমাজের কোন্ দল বা জোটকে ভোট দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে তাদের বিভিন্ন সংগঠন বা ধর্মীয় নেতৃত্বের নির্দেশ দেওয়ার প্রবণতা এবারে এখনও তেমন একটা চোখে পড়ছে না।
যেমন দিল্লির জামা মসজিদের শাহী ইমাম, কিংবা ভারতে মুসলিমদের প্রভাবশালী সংগঠন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড – কেউই এখনও আসন্ন নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেননি।
মুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট বিা রাজনীতিবিদরা অনেকেই অবশ্য বিবিসিকে বলছেন, ভারতের মুসলিমরা অন্য কারও কথায় নিজের ভোট স্থির করবেন সেই দিন পেরিয়ে এসেছে – আর তাই ধর্মীয় সংগঠনগুলোর বক্তব্যেরও তেমন একটা গুরুত্ব নেই।
ভারতে বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে জামা মসজিদের শাহী ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি, পার্সোনাল ল বোর্ডের নেতা মৌলানা কালবে জাওয়াদের মতো অনেক নেতাকেই বলতে শোনা গেছে, মুসলিমদের কোন্ দলকে ভোট দেওয়া উচিত।
পশ্চিমবঙ্গেও ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি ভোটের মরশুমে বরাবর জানিয়ে এসেছেন তার রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ – এবং এমন উদাহরণ আরও অজস্র।
কিন্তু ২০১৯-র সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে এসে দেখা যাচ্ছে এগুলোর প্রাসঙ্গিকতা ক্রমশ কমছে।
দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক স্মিতা গুপ্তা বলছিলেন, “বিজেপি যবে থেকে দেশে শক্তিশালী হয়েছে তখন থেকেই মুসলিমরা কিন্তু সচরাচর দেখেন, বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী কোন্ দলের।”
“এই মুহূর্তে যেমন আমি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে সফর করছি, এখানেও যেমন মুসলিমরা দেখছেন বিজেপিকে হারানোর ক্ষমতা কোন্ কেন্দ্রে কার বেশি – কোথাও সেটা সমাজবাদী-বসপা জোট, কোথাও আবার কংগ্রেস।”
“নব্বইয়ের দশকে রাম জন্মভূমি আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন মুসলিমরা বিক্ষোভ দেখাতে কথায় কথায় রাস্তায় নেমে আসতেন। কিন্তু এখন সে সব অতীত, তারাও বুঝে গেছেন ওভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে কোনও লাভ নেই।”
আসলে একুশ শতকের ভারতে মুসলিম ভোটাররাও এখন যথারীতি অনেক পরিণত, অনেক আধুনিকমনস্ক।
বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনের তৃণমূল কংগ্রেস এমপি মমতাজ সঙ্ঘমিতা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, তার অভিজ্ঞতা হল ধর্মীয় নেতারা কী বললেন সে সব শুনে কিন্তু মুসলিমরা ভোট দেন না।
তার কথায়, “ধর্মীয় নেতারা একরকম গাইড করলেই মুসলিমরা সেখানে গিয়ে ভোট দিত বা দেবে – ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক সেরকম নয়। ইদানীংকালে মনে হয় এই ধারণাটা খানিকটা তৈরি করা হয়েছে।”
“যেমন ইস্যুভিত্তিক বিবেচনা করলে আমরা আশা করব মুসলিমদের ভোট বিজেপির বিপক্ষেই যাবে। এটা আমাদের ধারণা ও আশা, সেখানে ধর্মীয় নেতারা কী বলল বা না-বলল তাতে খুব একটা কিছু আসে যায় না।
“তবে আমাদের সমাজে সব বিষয়েই তো ধর্মীয় নেতাদের কিছুটা প্রভাব থাকে। কিন্তু ভোটের বিষয়টা অন্য – তা না-হলে যারা ওই জামাত-ফামাত করেন তারা তো জামাতের পক্ষেই ভোট দিতে বলতেন।
“কিন্তু সেটা তো আর হয় না, ভোটের বিষয়টা মানুষের রোজকার খাওয়া-পরা, বেঁচে থাকার ইস্যুগুলোর ওপরই নির্ভর করে”, বলছেন মমতাজ সঙ্ঘমিতা।
ভারতের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আর একটা খুব প্রচলিত ধারণা হল, মুসলিমরা সচরাচর ‘অন ব্লক’ বা সমষ্টিগতভাবে ভোট দিয়ে থাকেন।
মুম্বাইতে ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনে’র নেত্রী নূরজাহান সাফিয়া নিয়াজ আবার বলছিলেন, এই ধারণাটা সব সময় মোটেও ঠিক নয়।
তিনি জানাচ্ছেন, “বোম্বেতেই যেমন আমরা দেখেছি স্থানীয় পুরসভার নির্বাচনে মুসলিমরা শিবসেনাকেও ভোটে জিতিয়েছেন – যে দলটি বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এই শহরের দাঙ্গার জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল।”
“এমন বেশ কিছু আসনে শিবসেনা কর্পোরেটর পেয়েছে, যেখানে অনেক মুসলিম ভোট না-পেলে তাদের জেতা সম্ভবই নয়।
“তবে কথা হল, ভারতে মুসলিমদের সামনে এখন অপশনটাই বা কী?”
“নিশ্চয় এমন একটা সাম্প্রদায়িক দলকে তারা বেছে নেবে না যারা প্রকাশ্যে তাদের আক্রমণ করছে?
“কিন্তু কংগ্রেস বা অন্য তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোই বা মুসলিমদের উন্নয়নে কী করেছে? কাজেই কম খারাপটা বেছে নেওয়াই বোধহয় একমাত্র রাস্তা,” বলছেন নূরজাহান সাফিয়া নিয়াজ।
লক্ষ্যণীয় হল, মিস নিয়াজের কথায় যেটা ”কম খারাপটা বেছে নেওয়া” – তার জন্য ভারতীয় মুসলিমরা কিন্তু আর ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে নেই।
আর হয়তো সে কারণেই শাহী ইমাম বা পার্সোনাল ল বোর্ডের নেতারাও এবারে ভোট নিয়ে মুখ খোলার প্রয়োজন বোধ করছেন না।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন