নতুন পদ্ধতিতে

ময়দা ছুঁড়ে ছবি এঁকে চমক কুড়িগ্রামের ছ’মিল শ্রমিক জসিমের

কুড়িগ্রামের নদীবেষ্টিত প্রত্যন্ত উপজেলা রৌমারীতে ময়দা ছুঁড়ে ছবি এঁকে চমক সৃষ্টি করছে জসিম। তার এ ছবি আঁকার নতুন পদ্ধতি দেখে ভীর জমাচ্ছে বিভিন্ন এলাকার মানুষ। অনেকে শখ করে নিজেদের ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে তার ছবি।

প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত এই যুবকের নতুন ক্যানভাসে ছবি আঁকার খবর এখন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছে দেশ থেকে দেশান্তরে।

আঁকিয়ে জসিম জানান, প্রথমে একটি কাঠের ফ্রেম দিয়ে ক্যানভাস তৈরী করেন তিনি। এরপর ক্যানভাসে পেন্সিল ও চক দিয়ে গ্রাফ ও আউট লাইন দেয়ার পর পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে ক্যানভাস পরিস্কার করেন। এরপর ছবিতে বিশেষ কায়দায় গাম আঠা ব্যবহার করে প্রাথমিক কাজ শেষ করেন। এরপর ছবির দিকে একাগ্রচিত্তে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সেই ছবিতে ময়দা ছুঁড়ে মারেন তিনি। কিছুটা পাগলাটে ভঙ্গিতে ময়দা ছুঁড়ে মারার পর ফুটে ওঠে ছবির পুরো অবয়ব। তারপর দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ছবির কাজ শেষ করেন।

এভাবে তার ছবি আঁকা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে দর্শনার্থীরা।

প্রত্যন্ত একটি এলাকায় এই ছেলেটির এমন ছবি আঁকায় মুগ্ধ সবাই। জসিমসহ সবার ইচ্ছে সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতায় তাকে যদি চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়ার সুযোগ করে দেয়া হয় তাহলে সে নিজের ভুল-ভ্রান্তিগুলো দূর করে সত্যিকারের একজন শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

সরজমিন ঘুরে জানা যায়, কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার প্রত্যন্ত চর শৌলমারী গ্রামে জসিমদের বাড়ী। যোগাাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। গ্রামের তিনদিক ঘিরে রয়েছে প্রমত্ত ব্রহ্মপূত্র নদ ও তার শাখানদী। শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই গ্রামের ছেলে বিশাল আহমেদ জসিম। বাবা-মায়ের ৪ সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান জসিম। এরপরেই রয়েছে ৩ বোন। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা পাশের পর পারিবারিক সংকটের কারণে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাবার ছ’মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে বাবা-ছেলে মিলে ছোট্ট ছ’মিলের উপার্জন দিয়েই চলছে তাদের সংসার।

জসিম জানান, ৫ম শ্রেণি থেকে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। সেই ছবি আঁকা আর থেমে থাকেনি। শ্রমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছবি আঁকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এটাই তার অন্যতম নেশা। তার ব্যতিক্রমধর্মী কাজের জন্যই আজ সবার নজর কেড়েছেন তিনি।

 

জসিমের ছবি আঁকা দেখতে এসে চর শৌলমারীর সোনাপুর গ্রামের মজিদ শেখ জানান, এর আগে আমি ছবি আঁকা দেখিনি। আজ প্রথম দেখলাম। তার প্রতিভা দেখে আমার মন ভরে গেছে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি এঁকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

জসিমের সহপাঠী বন্ধু আলমগীর মিয়া জানান, আমরা আশ্চার্য হয়ে তার ছবি আঁকা দেখি। একজন কবি যেমন লাইনের পর লাইন মনমুগ্ধকরভাবে আঁকে। সেরকম বিশাল আহমেদ জসিম পেন্সিল-চক-আঠা-ময়দা ব্যবহার করে গুণগুণ করে গাইতে গাইতে ময়দা ছুঁড়ে দিয়ে জ্বলন্ত একটি ছবি রুপ ধারণ করায়। আমরা তার কাজে মুগ্ধ।

চর শৌলমারী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন জানান, তার প্রতিভার ছটায় আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামটিকে মানুষ চিনুক, তার প্রতিভার বিকাশ ঘটুক এটাই আমরা চাই।

চর শৌলমারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মরিয়ম খাতুন জানান, আমাদের স্কুলে সে শেখ রাসেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জসিম উদ্দিনের ছবি এঁকে দিয়েছে। ছেলেটির প্রতিভা আছে কিন্তু পারিবারিক দারিদ্রতার কারণে সে অগ্রসর হতে পারেনি। আর্থিকভাবে সাহায্য করলে সে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।

জসিমের বাবা গোলাম হোসেন জানান, আমি জসিমকে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে পেরেছি। আর্থিক সংকটের কারণে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। সে ছোট তিন বোনের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের পড়াশুনা বন্ধ করে আমার ছোট ছ’মিলে কাজ করা শুরু করে। নিজে পড়ালেখা না করলেও এখন তার দু’বোনকে পড়াচ্ছে সে। তাদের একজন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এবং ছোট মেয়ে চর শৌলমারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণিতে পড়ছে। বড় মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়েছে। জসিমও বিয়ে করেছে। তার দুটি পুত্র সন্তান রয়েছে।

তিনি আরো জানান, তার ছবি আঁকায় আমি কোন বাঁধা দেই না। ছ’মিলের কাজ ফেলে সে অন্য কোথাও ছবি আঁকতে গেলে আমি অন্য শ্রমিক দিয়ে জরুরী কাজ সারি। আমার সামর্থ নেই। কেউ যদি ওর পাশে দাঁড়ায় তাহলে ছেলেটির আশা পূরণ হতো।

এ ব্যাপারে বিশাল আহমেদ জসিম জানান, ছোট বেলা থেকে আমি ছবি আঁকতাম। পরে ছবি আঁকার নেশায় পরে যাই। শুরুতে পেন্সিল স্কেচ করতাম। বন্ধুরা খুব উৎসাহ দিতো। সেগুলো ফেসবুকে আমার একাউন্টে প্রচার করতাম। তবে তেমন সাঁড়া পেতাম না। এরপর তেল রঙের কাজ করি। কাজ করতে করতে ফেসবুকে বিভিন্ন শিল্পীদের ছবি আঁকার ভিডিও দেখে নতুন পদ্ধতিতে ছবি আঁকার আগ্রহ বোধ করি। সেখান থেকে আমি ময়দা ছুঁড়ে ছবি আকার পদ্ধতি বেচে নেই। এ ব্যাপারে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই। ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউটে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সামর্থ না থাকায় পড়তে পারিনি। আমি চারুকলায় পড়তে চাই। এখন পর্যন্ত দেড়শ’র মতো ছবি এঁকেছি। সেভাবে বিক্রি করার চেষ্টা করা হয় নাই। ভালোবেসে অনেকের ছবি এঁকে দিয়েছি। কেউ খুশি হয়ে টাকা দিয়েছে, কেউ দেয় নাই। এনিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। আর্ট তো আর্টই! আর্টতো বিক্রির জিনিস নয়।