মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী
ঋতুবদলে শীত শেষে বসন্ত এসেছে, সেই সঙ্গে রাজধানীতে আতঙ্ক নিয়ে ফিরে এসেছে মশা। মিরপুরের কালসী রোডের চা বিক্রেতা ফজলুল হককে দিনে-দুপুরেও দোকানে মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে। ভাষানটেক এলাকার গৃহিনী ফিরোজা বেগম মশারি টানিয়ে সারারাত কয়েল জ্বালিয়েও শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন না।
আর উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের ফাহমিদা হক বলছেন, গত দুই সপ্তাহে মশার উপদ্রপ এতটাই বেড়েছে যে তার বাসায় মশার কয়েল, স্প্রে, মশা মারার ব্যাট- কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। তার শিশু সন্তানকে সারাদিনই বিছানায় মশারির মধ্যে রাখতে হচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) নগরবাসীর অভিযোগ, সিটি করপোরেশন ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, মশার ওষুধ ছিটিয়েও তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আর দক্ষিণের মেয়র মশক নিধনে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ হাতে নেয়ার কথা বলেছেন।
এখন ঢাকায় যে কিউলেক্স মশার উৎপাত চলছে, তাতে মারাত্মক কোনো রোগের ঝুঁকি কম হলেও গত দুদিনের বৃষ্টিতে এডিস মশার উপদ্রব বাড়তে পারে এবং সেক্ষেত্রে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা।
শীত শেষে আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে ওঠায় ঢাকার জলাশয় ও নালা-নর্দমাগুলোর জমে থাকা পানিতে মশার প্রজননও বেড়ে গেছে। কালসী রোডের চা বিক্রেতা ফজলুল হক জানালেন, দিনের বেলা তিনি দোকানে কয়েল জ্বালিয়ে খদ্দেরদের ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সন্ধ্যায় কয়েলেও আর কাজ হয় না।
দেখেন, দুপুর বেলায় পায়ের কাছে কেমন ভ্যানভ্যান করতাছে। সন্ধ্যার আগে কয়েলেও কাম হইব না, ব্যাট দিয়া মশা মারতে হইব। তখন আপনেও এইখানে দাঁড়াইতে পারবেন না। উড়াইয়া নিয়া যাইব।
উড়িয়ে নেয়ার কথা তিনি কথার ছলে বললেও মশার কারণে ঢাকায় বিমানের ওড়া আটকে যাওয়ার ঘটনাও গত সপ্তাহে ঘটেছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং ৭৩৭-এ মশার উৎপাতে ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। কেবিন ক্রুরা মশা মারার পর দুই ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায় ওই ফ্লাইট।
উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আতিকুর রহমান জানান, তার এলাকায় খোলা নর্দমাগুলোয় পানি জমে থাকায় গত ১৫দিন ধরে মশার উৎপাত বেশি বেড়েছে। নতুন ড্রেইন বানানো পরে আমাদের এখানে কোনো ঢাকনা দেয় নাই। পানি জমে থাকায় সেখানে মশা হচ্ছে। আমরা থাকি পাঁচতলায়, বাসার জানালা জাল দিয়ে ঘেরা। মশা এত বেশি, যে দরজা খুলে আবার লাগানোর ফাঁকেই মশা ঢুকে যায়।
কোনো কিছুতেই মশার যন্ত্রণা কমাতে না পেরে রাতে বাতি জ্বালিয়ে বসে থাকছেন শনির আখড়ার গৃহিনী নার্গিস বেগম। অন্ধকার পাইলে মশা একবারে ঝাঁপাইয়া পড়ে। মশারি টানাইলেও কাজ হয় না। বাচ্চারা বাথরুমে যাইতে মশারি থাইকা বাইর হইলেই মশা ঢুইকা যায়। গত রাতে বাতি জ্বালাইয়া জাইগা ছিলাম। বাতি জ্বালাইলে মশা একটু কম ধরে।
বাসাবো কদমতলা এলাকার বাসিন্দা কাওসার আহমেদের অভিযোগ, তার এলাকায় গত কয়েক দিনে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা তিনি দেখেননি। কোনো ওষুধ দেয় না, ধোঁয়া দেয় না। আমি এই এলাকায় ফগার মেশিন দেখি নাই। ওষুধ দিলে তো মশা কমত, মশাতো কমে না।
মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ৬ নম্বর সড়কের গৃহিণী তাসরিন আক্তার বলেন, মশার সমস্যা তো সারাবছরই থাকে। কিন্তু শীত কমার পর মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আমি থাকি নয় তলায়, এখানেই এই অবস্থা; নিচতলায় যারা থাকে তাদের অবস্থা যে কি আল্লাহ জানে।
নগরবাসীর অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. ওসমান গণি বলেন, তারা কিছু করছেন না- এ অভিযোগ ঠিক নয়। আমরাতো মশার ওষুধ ছিটাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখছি। মশাতো কমছে না। এজন্য আবার পলিসি চেইঞ্জ করছি। একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রামে আমরা যাব। কীভাবে কি করা যায় সেটা নিয়ে আমরা মঙ্গলবার বসব।
ধানমণ্ডি, রামপুরা, খিলগাঁও, কামরাঙ্গীরচরসহ রাজধানীর প্রান্তের এলাকাগুলোতে মশার উপদ্রব বাড়ার কথা স্বীকার করলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন দাবি করেন, পুরান ঢাকায় মশার উৎপাত তুলনামূলকভাবে কম।
পুরান ঢাকাসহ ডিএসসিসির ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ এলাকায় মশার উৎপাত তুলনামূলক সহনীয়। এসব এলাকায় ঝোপঝাড় কম। বাকি এলাকাগুলোতে মশার উপদ্রব আছে। তারপরও সাউথ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশার অবস্থা আমার মনে হয় টলারেবল।
মশার উৎপাত যাতে আর বাড়তে না পারে সেজন্য বুধবার থেকে ডিএসসিসি ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামে’ যাচ্ছে বলে জানান মেয়র। আমরা আমাদের মশক নিধনে নিয়োজিত সব ওয়ার্ক ফোর্স এবং মেশিনারি নিয়ে একদিন একটা জোনে কাজ করব। সেখানে এমনভাবে কাজ করব যেন পরের সাতদিন সেখানে মশা না দেখা যায়। এভাবে পাঁচটা জোনে কাজ করা হবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর জানান, এখন যে মশা উৎপাত করছে সেগুলো কিউলেক্স মশা। এ মশার মাধ্যমে মারাত্মক রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি কম।
ঢাকায় এই মশা কামড়ালে তেমন অসুখ হয় না। তবে খুবই বিরক্তি উৎপাদন করে। তবে ঢাকার বাইরে ফাইলেরিয়াপ্রবণ এলাকায় এই মশা কামড়ালে ফাইলেরিয়া হতে পারে। মাঝ ফাগুনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সোমবার ভোরে ঢাকায় একদফা ঝড় বয়ে যায়। রাতে আরেকদফা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হয়।
আলমগীর বলেন, বৃষ্টির পর কোথাও পরিষ্কার পানি জমে থাকলে এডিস মশাও বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে এখন থেকেই সতর্ক থাকা দরকার। এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে বেশি হয়। বৃষ্টি হলে পুরনো পানি সরে যায়, নতুন পানি জমা হয়। এ কারণে সেসব জায়গায় এডিস মশা জন্ম নেয়। এভাবে এডিসের উপদ্রব বাড়তে পারে। ঘরের ভেতরেও যেন জমা পানিতে মশা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন