মহররমের আশুরার দিনে যত ঘটনাবলী ও ফজিলত

মহররমের আশুরার দিনে যত ঘটনাবলী ও ফজিলত

আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর

হাদিস শরীফে চান্দ্র বর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহররমকেই শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবার ৩৬নং আয়াতাংশে উল্লেখ আছে- আরবায়াতুন হুরুম অর্থাৎ অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চারটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। আরবি বর্ষপঞ্জি হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। মহররম মাসের দশ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আশুরা শব্দটি আরবি শব্দ আশারা থেকে এসেছে। আশারা মানে দশ এবং আশুরা অর্থ হলো দশম। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন- ‘রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’
মহররম ও আশুরার শিক্ষা হলো ত্যাগের মহিমায় নিজেকে উজ্জিবীত করা, সত্য ও ন্যায়ের অনুসরণ এবং অসত্যকে বর্জনসহ অন্যায়ের প্রতিবাদে দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়া, ষড়ঋপু নিয়ন্ত্রণে ব্রতী হওয়া (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য), নিষ্কাম কর্ম করা, আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করা, তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকা।
হযরত হাফসা (রা.) বলেন, ‘রাসুলে পাক (সা.) চারটি কাজ কখনো ত্যাগ করেননি। যথা- ১. আশুরার রোজা, ২. জিলহজের প্রথম ৯ দিনের রোজা, ৩. আইয়ামে বিজের রোজা তথা প্রতিমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা এবং ৪. ফজর ওয়াক্তে ফরজের পূর্বে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ।’
মহররম মাসের আশুরার দিনটি সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনেই পৃথিবীর বহু উল্লেখযোগ্য, স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস প্রসিদ্ধ ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয় বলে প্রচলিত আছে। প্রচলিত সেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে এইদিনে- ১. পৃথিবীর সৃষ্টি এবং ধ্বংস অর্থাৎ আল্লাহ পাক লওহে মাহফুজ ও প্রাণিকুলের প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, দুনিয়ার সমস্ত সমুদ্র-মহাসমুদ্র ও পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি তথা পৃথিবীর সৃষ্টি এবং একই সাথে ধ্বংস, ২. হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা ও একই দিনে জান্নাতে প্রবেশ, ৩. একই দিনে হযরত আদম (আ.) কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ, ৪. ৩৬০ বছর পর গুনাহ মার্জনার পর হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়াকে আরাফাতের ময়দানের জাবালে রহমতে পুনঃসাক্ষাৎ লাভ, ৫. ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হযরত আইউব (আ.) কে রোগমুক্তি দান, ৬. হযরত ইদ্রিস (আ.) কে আকাশে উত্তোলন, ৭. হযরত নূহ (আ.) কে তুফান ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণ দান, ৮. হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে দুনিয়াতে আগমন ও পরবর্তীতে একই তারিখে অগ্নিকুন্ড থেকে নিস্কৃতি প্রদান, ৯. হযরত দাউদ (আ.) কে বিশেষ ক্ষমা প্রদান, ১০. হযরত সোলায়মান (আ.) কে স্বীয় হারানো বাদশাহী প্রদান করা, ১১. হযরত ইউনূস (আ.) কে ৪০ দিন পর মাছের উদর বা পেট থেকে উদ্ধার, ১২. হযরত ইয়াকুব (আ.) এর স্বীয় হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) সঙ্গে সাক্ষাত লাভ, ১৩. এদিনে হযরত মুসা (আ.) কে আক্রমন করতে গিয়ে নীল নদে ডুবে ফিরাউনের মৃত্যু তথা ফিরাউনের কবল থেকে মুসা (আ.) এর নিষ্কৃতি লাভ, ১৪. হযরত ঈসা (আ.) এর দুনিয়ায় আগমণ ও পরবর্তীতে এই দিনেই আকাশে উত্তোলন, ১৫. এইদিনেই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন, ১৬. প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শরীফ থেকে হিজরত করে মদীনা শরীফে গমন, ১৭. এইদিনে নবীকুল শিরোমনি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম ওহি প্রাপ্ত হন, ১৮. জালিম এজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার ৭৭ জন পরিবার-পরিজন, ঘনিষ্টজন নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ যা ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা, ১৯. আল্লাহ পাকের নির্দেশ অনুযায়ী কেয়ামত ঘটানোর লক্ষ্যে এই তারিখে হযরত ইসরাফিল (আ.) সিঙ্গায় ফুক দিবেন।
এছাড়া, মহররম মাসে ফেরেশতাদের দ্বারা প্রথম মুসলমানদের পূন্যভূমি কাবাগৃহ তৈরী করা হয়। এই মাসেই তুর পাহাড়ের পাদদেশে আল্লাহ পাকের সাথে হযরত মুসা (আ.) এর কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন এবং তাঁর নবুওয়াতি ও তাওরাত কিতাব লাভ হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, মহররম মাসের ১০ তারিখ দিনটিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ন্যায় সত্য আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের মহিমান্বিত স্মৃতিবিজড়িত কারবালার শোকাবহ মর্মস্পর্শী হৃদয় বিদায়ক ও বিষাদময় ঘটনা সংঘটিত হয়। ৬৮০ খৃষ্টাব্দ, ৬১ হিজরী সালে ১০ মহররম আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরীর অদুরে ফোরাত নদীর তীরবর্র্র্র্র্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক এজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার পরিজন ও ৭৭ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন।

মূলত: কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর মৃত্যু ঘটেনি, প্রকৃত মৃত্যু ঘটেছে পাপিষ্ট এজিদের। কারণ যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন ঘৃণা, নিন্দা, বিদ্বেষ, ধিক্কার ও অভিশাপ চলতে থাকবে এজিদ ও তার বাহিনীর উপর। পক্ষান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)কে দরুদের মাধ্যমে স্মরণ রাখবে সারা মুসলিম জাতি। এভাবে আজীবন সত্য, আদর্শ এবং ন্যায়, সততার বিজয় উদ্ভাসিত হবে।

১০ মহররম আশুরার দিনে বিষাদ সিন্ধু সম্বলিত কারবালার নির্মম ঘটনা ইসলামের জন্য আত্ম্যাগের দীক্ষা ও শিক্ষা। অন্যায়কে প্রতিহত করে সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার শিক্ষা আমরা কারবালার ঘটনা থেকে গ্রহন করতে পারি। জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে তারা ন্যায়, সত্য ও আদর্শকে চিরভাস্বর করে রেখে গেছেন। সেই হৃদয়ভাঙ্গা বেদনাকে স্মরণ করে ১০ই মহররম মুসলিম বিশ্ব কারবালার শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ইবাদত বন্দেগী করেন।
উল্লেখ্য যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন, মহররম মাসের আশুরার দিনে রোজা রাখলে পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ও গুনাহ আল্লাহ মোচন করে দেন। আমাদের এ মাসে রাসলুুল্লাহ (সা.) এর প্রতি অধিক দরুদ ও সালাম পেশ, নফল নামাজ, কোরআন মজিদ তেলাওয়াত, আশুরার দিনে এবং অন্যদিনেও রোজা পালন হাদীস শরীফ অধ্যয়ন, দান-সাদকাহ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বিশেষভাবে ইসলামের কল্যানে জীবনকে নিবেদিত করা উচিত।

আশুরার রজনী এক মহিমান্বিত সম্মানিত, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, পূন্যময়, বরকতময় ও মহা পবিত্র রজনী। এ রজনীতে উম্মতী মুহাম্মদীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয়। এ রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাতœ্য সর্বাধিক ও সুদুরপ্রসারী। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা না থাকলে সমাজে কেউ নিরাপদ নয়। মহররম সকল অন্যায়, পাপাচার, দুরাচার ও সহিংসতাকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের মানসিক, দৈহিক ও আত্বিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়।

মহররম হিজরী সনের ফজিলত ও শিক্ষার মাস। আতœসচেতনতার মাস। মুসলমানদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার মাস। মহররম আসে অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, সাহসিকতার পথ প্রদর্শক হিসেবে। মহররম আসে নির্ভীক পথ চলার কল্যাণময় শুভ বার্র্তা নিয়ে। মহররম আসে আমাদের পুরাতন বছরের জরাজীর্নতাকে ধুয়ে মুছে নতুনরূপে নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে। মহররম আসে আমাদের নতুন শপথ ও প্রত্যয় গ্রহনের অঙ্গীকার নিয়ে। মহররম যেন অফুরন্ত জয়ের দূরন্ত সূচনা।

লেখক:
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেক পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, বাংলাদেশ।
মোবা: ০১৭১৭-০৮৪৭৯৩