মাদকবিরোধী অভিযান : দুই সপ্তাহে ৪১ জেলায় নিহত ১১৮
মানবাধিকারকর্মীদের তীব্র সমালোচনা আর রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে দেশজুড়ে বন্দুকযুদ্ধ চলছে। সরকার ঘোষিত মাদকবিরোধী অভিযানের প্রথম দুই সপ্তাহে (১৫ মে থেকে ২৯ মে) দেশের ৪১ জেলায় কমপক্ষে ১১৮ জন মারা গেছে। যার মধ্যে ১১৬ জনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে।
এ ছাড়া ধাওয়ার মুখে ঝিলের কাদাপানিতে ডুবে এবং গণপিটুনিতে মারা গেছে বাকি দুজন। নিহতদের ১১১ জনকে মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সপ্তাহের শুরুতে কক্সবাজারে সরকারদলীয় পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যাসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় এরই মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ‘মাদকবিরোধী বন্দুকযুদ্ধ’। এর আগের সপ্তাহে নেত্রকোনায় ছাত্রদলের এক নেতা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরই শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক।
এ ছাড়া চট্টগ্রামে মাদক ব্যবসায়ীর বদলে একই নামের সাধারণ ব্যক্তির পাশাপাশি তার ব্যাপারে ভুল তথ্য দেওয়া সোর্সকে হত্যারও অভিযোগ উঠেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকারকর্মীদের শঙ্কাও বাড়ছে। আসল অপরাধীরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন তারা।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, প্রতিটি হত্যার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে এসব ঘটনা ঘটছে, সেটা জানার অধিকার আমাদের আছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও জানানোর দায়িত্ব রয়েছে।
আরেক মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, অনেকে মনে করেন বিচারবহির্ভূত হত্যার মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে কিছু একটা অর্জন করা সম্ভব। সেই চিন্তা থেকেই এর সূচনা। কিন্তু ফলাফল যে শূন্য, তা গত দশ-পনেরো বছরের অভিজ্ঞতায় পরিষ্কার। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বেই থেকে যাচ্ছে।
সুলতানা কামালের কথা হচ্ছে, জনগণের করের পয়সায় কেনা সরকারি অস্ত্র সংবিধান ও আইন মেনে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও কিন্তু রাষ্ট্রের। আর নূর খান লিটনের অভিমত, এ ধরনের অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা উচিত।
এর আগে অভিযান শুরুর পরই এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে সারা দেশে অভিযান চলছে। যত দিন না মাদক ব্যবসা ও সেবন নির্মূল হয়, এটা অব্যাহত রাখা হবে। সেদিনই আরেক অনুষ্ঠানে ‘মাদক নির্মূলে অভিযান চলছে’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীও জানান, যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করা হয়েছে, একইভাবে মাদকের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করা হবে।
প্রসঙ্গত, জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালেও বন্দুকযুদ্ধের বহু ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ১৭০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪৭ ব্যক্তি গুম হয়েছে।
তারা বলছে, চলতি বছরের ২১ মে পর্যন্ত ১০২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, ১৪ মে রাত তথা ১৫ মে প্রথম প্রহর থেকে সোমবার রাত অর্থাৎ ২৯ মে প্রথম প্রহর অবধি কুমিলায় সর্বোচ্চ ১২ জন মারা গেছেন। এরপরই অবস্থান যশোরের। সেখানে ১০ ও তৃতীয় সর্বোচ্চ ফেনীতে সাতজন মারা গেছে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়ায় ৬ জন করে, সাতক্ষীরায় ৫, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও কক্সবাজারে ৪ জন করে, চুয়াডাঙা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও চাঁদপুরে তিনজন করে, পিরোজপুর, বরগুনা, পাবনা, মাগুরা, গাইবান্ধা, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও নীলফামারীতে দুজন করে এবং বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী, মেহেরপুর, বাগেরহাট, খুলনা, জয়পুরহাট, কুড়িগ্রাম, শেরপুর, রংপুর, নরসিংদী, গাজীপুর, লালমনিরহাট ও জামালপুরে একজন করে নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ফেনীর এক শিশু ধর্ষক, বরিশালের এক ছিনতাইকারী, ময়মনসিংহ ও যশোরে হত্যা মামলার আসামি এবং পাবনার এক ডাকাত রয়েছে। বাকি সবাইকে মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করেছে র্যাব ও পুলিশ।
এরই মধ্যে ‘নেত্রকোনায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রদলের সদস্য আমজাদ হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে’ বলে অভিযোগ করে ২২ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, মাদক নির্মূলের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে হিড়িক চলছে, তাতে গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। সরকার টার্গেট করে বিরোধী নেতাকর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে মেরে ফেলছে।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, যাদের ধরা হচ্ছে তারা মাদকের শীর্ষ ব্যবসায়ী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের জীবন বাঁচাতে বন্দুকযুদ্ধে বাধ্য হচ্ছে।
আইনের মধ্যেই ‘অভিযান’ হতে হবে : আসক’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, একটা গণতান্ত্রিক সমাজে সম্ভাব্য অপরাধী বা অভিযুক্তকে রক্ষা করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। যেকোনো অভিযান অবশ্যই আইনের ভেতরে থেকে পরিচালিত করতে হবে। এভাবে ঘোষণা দিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করে অপরাধ দমন করা যাবে না।
সুলতানা কামাল বলেন, তারা (র্যাব-পুলিশ) বলে থাকেন তাদের যে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হয়েছে, তা সাজিয়ে রাখার জন্য নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন, তারা এগুলো নিয়মনীতি মেনে ব্যবহার করছেন কি না। যেভাবে বন্দুকযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, সেই যুদ্ধের পরিস্থিতি আসলেই সৃষ্টি হয়েছিল কি না।
যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এবং তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের নক করা হচ্ছে।
এর আগে ১৪ মে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদও এক সংবাদ সম্মেলনে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন। সেদিন তিনিও বলেন, মাদক ও জঙ্গি অপরাধ অন্য কোনো অপরাধের মতো নয়। ওই দিন থেকেই বন্দুকযুদ্ধের প্রকোপ বেড়ে যায়। সুলতানা কামাল বলেন, মাদক একটা ভয়ানক সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করাও দরকার। তবে সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস দমন হয় না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বা আইনি যে উপায় আছে, সেটাই গ্রহণ করা সমীচীন। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেমে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তে কমপক্ষে ১২ হাজার নাগরিককে হত্যা করেন। এর উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ফিলিপাইনের অভিযান কিন্তু কাক্সিক্ষত ফল পায়নি।
আড়ালে থাকছে ‘আসল অপরাধীরা’ : মাদক অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করুন, উল্লেখ করে সরকারের প্রতি বিএনপি নেতা রিজভী প্রশ্ন রাখেন, মাদকের আসল গডফাদারদের ধরছেন না কেন?
জবাবে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেন, মাদকের কোনো চুনোপুঁটিদের ধরা হচ্ছে না। চুনোপুঁটিদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না। তবে সুলতানা কামালও বলেন, যারা আসল অপরাধী তারা সামনে আসছে না। তাদের কোনো পরিচয়ও জানা যাচ্ছে না।
নূর খান লিটনের বক্তব্য, এটা গডফাদারদের আড়াল করার ষড়যন্ত্র বা কৌশল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। কথিত সন্দেহভাজনদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে বিধায় অপরাধের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে না দাবি করে লিটন আরো বলেন, ওদের জীবিত ধরতে পারলে মূল হোতাদের নাম পাওয়া যেত। চলমান মাদকবিরোধী যুদ্ধ নিয়ে দেশজুড়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠনগুলো। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিতর্ক চলছে।
নূর খান বলেন, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততার খবর দেখেছি, সেখানে এভাবে মাদকমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জনগণকে আগে সচেতন করতে হবে। সামাজিক শক্তিগুলোকে মাদকের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে হবে।
এরই মধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে রোববার থেকে র্যাবের উদ্যোগে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান-সংবলিত পোস্টার, লিফলেট বিলি শুরু হয়েছে।
এই কর্মসূচি উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানে কাউকে ছাড় দেবে না সরকার।
তবে সুলতানা কামাল বলেন, একটি অপরাধ দমনে আরেকটি অপরাধ করার এ ধরনের চর্চা আশা করি শিগগিরই বন্ধ হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন