নেপালের তদন্ত প্রতিবেদনে দাবি
মানসিক চাপে ছিলেন বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলার পাইলট
মার্চে নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পড়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিএস২১১ ফ্লাইটের পাইলট প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিলেন। ঢাকা-কাঠমান্ডুর এক ঘণ্টার ফ্লাইটে তিনি ককপিটের মধ্যে ক্রমাগত ধূমপান করেছিলেন। এছাড়া অবতরণের সময় পাইলট কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে মিথ্যা কথাও বলেছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে দুর্ঘটনাটি নিয়ে নেপাল সরকারের তদন্ত দলের প্রতিবেদনে। তদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার দাবি করে এসব তথ্য জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট।
গত ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ড্যাশ-৮ কিউ 8০০ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। বিমানটিতে চারজন ক্রু ও ৬৭ যাত্রীসহ ৭১ জন আরোহী ছিলেন। তাদের মধ্যে চারজন ক্রুসহ ২৭ জন বাংলাদেশি, ২৩ জন নেপালি ও একজন চীনা যাত্রী নিহত হন। আহত হন নয়জন বাংলাদেশি, ১০ জন নেপালি ও একজন মালদ্বীপের নাগরিক।
তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, বিমানটির পাইলট আবিদ সুলতান প্রচণ্ড ব্যক্তিগত মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। আর তার ধারাবাহিক কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিএস২১১ ফ্লাইটটির বিমান বিধ্বস্ত হয়।
তবে দুর্ঘটনার পর ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ জানায়, উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের কোনও ভুল ছিল না। ১৩ মার্চ ইউএস বাংলার জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ক্যাপ্টেনের কোনও প্রবলেম আমরা আসলে খুঁজে পাইনি।’
ঘটনার পরপরই এই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স ও ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দাবি, পাইলটের ভুলেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। আর ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হচ্ছিলো তাদের।
রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ফ্লাইটের পুরো সময় জুড়ে সুলতান অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন যা তার স্বাভাবিক আচরণের সঙ্গে যায় না। আর সেকারণেই তাৎক্ষণিকভাবে লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন নেপালের তদন্তকারীরা।
অবতরণের ছয় মিনিট আগে সুলতান নিশ্চিত করেছিলেন বিমানের ল্যান্ডিংগিয়ার নিচে নেমে আটকে গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিমানের ককপিটের ইলেকট্রিক নির্দেশক লাইটের উল্লেখ করে পাইলট বলেন, গিয়ার নিচে নেমেছে, তিনটি সবুজ বাতি জ্বলছে। সহকারী পাইলট পৃথুলা রশিদ যখন চূড়ান্ত ল্যান্ডিং তালিকা পরীক্ষা করছিলেন তখন ধরা পড়ে গিয়ার নিচে নামেনি। কয়েক মিনিট পর দ্বিতীয় অবতরণ চেষ্টার সময় ৬৭ জন যাত্রী ও চার ক্রু সদস্য বহনকারী বিমানটি রানওয়েতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে আগুন ধরে যায়।
তদন্তকারীরা বলছেন, এক ঘণ্টার ওই ফ্লাইটে সুলতান ক্রমাগত ধূমপান করেছিলেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক এই পাইলটের সাড়ে ৫ হাজার ঘণ্টার উড্ডয়নের রেকর্ড ছিল। তবে তিনি তার ধূমপানের অভ্যাস থাকার তথ্য বিমানসংস্থাকে জানাননি। এ থেকে তদন্তকারীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন ককপিটে থাকার সময়ে তিনি মানসিক চাপে ছিলেন।
তদন্তকারীরা ওই রিপোর্টে লিখেছেন, ‘ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি ক্যাপ্টেন প্রচন্ড মানসিক চাপ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এছাড়া তাকে বিষন্ন ও কম ঘুমের সমস্যায় থাকা মানুষ মনে হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন।’ ওই ভয়েস রেকর্ডারে ককপিটে তার ও তার সহকারী পাইলটের মধ্যে এক ঘণ্টার কথোপকথন রেকর্ড হয়েছিল। কথোপকথনের এক পর্যায়ে দেখা গেছে চিন্তিত থাকা সুলতান পরিস্থিতিগতভাবেও সচেতন ছিলেন না বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তদন্তকারীরা।
ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফ্লাইটের সময় সুলতান এয়ারলাইন্সের অপর এক নারী সহকর্মীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন। ওই নারী সহকর্মী ইন্সট্রাক্টর হিসেবে সুলতানের সুনাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এক ঘণ্টার ওই আলাপে দুইজনের সম্পর্কই ছিল আলাপের অন্যতম বিষয়বস্তু। রেকর্ড অনুযায়ী সহকারী পাইলট পৃথুলা পুরো ঘণ্টাব্যাপী ফ্লাইটে শুধু পরোক্ষ শ্রোতা হিসেবে তার আলাপ শুনে গেছেন।
নেপাল এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেন সারওয়ান রিজাল কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেছেন, বিমান অবতরণ বা উড়াল দেওয়ার সময়ে ককপিটে সহকর্মীদের মধ্যে যাবতীয় ব্যক্তিগত আলাপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, ‘ককপিটে এই নিয়ম কঠোরভাবে অনুনরণ করা হয় কারণ পাইলটকে পুরোপুরিভাবে বিমান চালনায় মনোযোগ রাখতে হয়।’
মার্কিন ফেডারেল অ্যাভিয়েশন প্রশাসনের নীতি অনুযায়ী, ফ্লাইটের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবে ১০ হাজার ফুটের নিচে উড্ডয়নের সময়ে বিমানের পাইলটদের সব ধরণের অপ্রয়োজনীয় কাজ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। কয়েকটি বিমান দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে এমন পরিস্থিতিতে বিমান চালকদের অপ্রয়োজনীয় কাজে মনোযোগ রাখতে দেখা যাওয়ায় ১৯৮১ সালে এই নিয়ম চালু করা হয়।
অডিও রেকর্ডারের তথ্য অনুযায়ী, ফ্লাইটের এক পর্যায়ে পাইলট ভেঙে পড়েন। বলেন, তিনি ওই নারী সহকর্মীর আচরণে খুবই আঘাত পেয়েছেন ও হতাশ হয়েছেন। আর ওই নারীই একমাত্র কারণ যার জন্য তিনি কোম্পানি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সুলতান দুর্ঘটনার একদিন আগে কোম্পানি থেকে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন জানিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে। তবে তিনি কোনও লিখিত নথি জমা দেননি। সহকারী পাইলটের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে আরও তিনমাস কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার কথাও বলেছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে ইউএস বাংলায় যোগ দেন সুলতান। বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালানোর আগে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ছিলেন। তবে রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, তার মানসিক চাপে থাকার ইতিহাস রয়েছে। মানসিক মূল্যায়নের পর ১৯৯৩ সালে তাকে বিমানবাহিনীর সক্রিয় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে ২০০২ সালের ৯ জানুয়ারিতে তার মানসিক পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়নের পর তাকে ফ্লাইট চালানোর উপযোগী বলে ঘোষণা করা হয়।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, সুলতানকে নিয়োগের সময়ে তার মেডিক্যাল ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখেনি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। নেপালের এই প্রতিবেদনের বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র ও ব্যবস্থাপক কামরুল ইসলামের কাছে কাঠমান্ডু পোস্ট যোগাযোগ করলেও তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন