মানুষকে অসামাজিক করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো
বর্তমানে তরুণদের পছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। অবসর সময় কাটানো, ঘুরতে যাওয়া, খেলতে যাওয়া ইত্যদি সবকিছুতেই সঙ্গী হিসেবে থাকছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অবশ্য এখন প্রায়ই মানুষকে তার প্রিয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে শোনা যায় যে, ‘সে এগুলোর প্রতি এতটাই আসক্ত যে আমাদের খোঁজ নেওয়ার সময় পায় না।’ তবে কী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেবল নামেই সামাজিকতা, কাজের ক্ষেত্রে কি সামাজিকতা রক্ষার চেয়ে অসামাজিক করে তুলছে মানুষকে?
এসব প্রশ্নের উত্তর নানাজন নানাভাবে দিয়ে থাকেন। উন্মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে বলা রয়েছে, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো কম্পিউটার-কেন্দ্রিক এক ধরনের প্রযুক্তি যা ভার্চুয়াল কমিউনিটি এবং নেটওয়ার্কের মধ্যে মানুষকে বিভিন্ন তথ্য, ধারণা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত বিষয় এবং অন্যান্য ঘটনা ভাগাভাগি করার সুযোগ করে দেয়।’ বর্তমানে অসংখ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকলেও ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, স্কাইপ, রেড্ডিট ইত্যাদিই বেশি জনপ্রিয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বর্তমানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ফেসবুক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা এগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ করার সময়ও তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মিটিং, সেমিনার ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়েও তারা এসব সাইট বাদ দিতে পারছেন না। এছাড়া নিত্যদিনের বন্ধুদের আড্ডায়, পারিবারিক অনুষ্ঠানে এবং অন্যান্য নানাক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে একই পরিস্থিতি।’
তথ্য প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘সরাসরি সাক্ষাতের কোনও বিকল্প নেই। প্রযুক্তি যে পর্যায়েই যাক না কেন, এর বিকল্প কখনোই তৈরি হবে না। তবে একটা বিষয়, সামাজিক যোগাযোগ বা প্রযুক্তি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। যেখানে আমি যেতে পারছি না বা যা পাওয়ার পরিস্থিতি নেই, সেটা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে। তবে এটা শুধু তেমন জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। বন্ধু, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর না হয়। আবার যখন আমি কারও সঙ্গে কথা বলছি, তখন পূর্ণ মনোযোগ তার প্রতিই থাকা উচিত।’
অনলাইন নির্ভর সামাজিক যোগাযোগ কি বাস্তবে আমাদের অসামাজিক করে ফেলছে? বেশ কয়েকদিন আগে এই প্রশ্ন নিয়ে একটি বিতর্ক ছাড়া হয়েছিল ‘ডিবেট ডট ওআরজি’ ওয়েবসাইটে। বিতর্কে পশ্চিমা দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই মূলত অংশ নিয়েছিলেন। ফল- ৮১ শতাংশ মত দেন পক্ষে অর্থাৎ হ্যাঁ, আর ১৯ শতাংশ বিপক্ষে। এই বিতর্কের মন্তব্যগুলোর সারমর্ম এই যে, ‘স্মার্টফোন আপনাকে আপনার ভাই-বোন, মা-বাবা, সঙ্গী, সন্তানের কাছ থেকে একা করে ফেলে। সামাজিকভাবে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন।’
প্রায় একইরকম বিষয় নিয়ে জরিপ চালিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিটাল ক্ল্যারিটি’। ১ হাজার ৩০০ মানুষের ওপর চালানো এই জরিপে ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রতি মানুষের আসক্তির বিষয়টি জনসমক্ষে উঠে এসেছে। জরিপের ফলে দেখা যায়, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা দৈনিক গড়ে ১৫ ঘণ্টা অনলাইনে সময় ব্যয় করেন। যে কারণে মানসিক নানারকম পরিবর্তন ঘটছে তাদের মধ্যে। এরমধ্যে রয়েছে অযথা সময় নষ্ট করা, সময়জ্ঞান না থাকা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, অফলাইনে থাকলে একধরনের অস্থিরতায় ভোগা ইত্যাদি।
জরিপে অংশ নেওয়া এক ব্রিটিশ ছাত্রী মেলিসা স্কট মনে করেন, তিনি রীতিমতো ইন্টারনেটে আসক্ত। তিনি বলেন, ‘আমি যতোক্ষণ জেগে থাকি সব সময়ই অনলাইনে থাকি। অফলাইনে গেলে আমার মধ্যে হতাশা কাজ করে এবং তখন নিজেকে অসুস্থ মনে হয়।’
দুনিয়া জুড়ে তথ্যপ্রযুক্তির এই উত্থান, তা নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত সমাজবিজ্ঞানী ম্যানুয়ের ক্যাসলস ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল, এই ক’বছর গবেষণা করে ইনফরমেশন এজ (তথ্য যুগ) নামে তিন খণ্ডের বই লিখেছেন। এর প্রথম খণ্ড হলো- ‘দ্য রাইজ অব নেটওয়ার্ক সোসাইটি’, ‘দ্য ইনফরমেশন এজ: ইকোনমি’, ‘সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’। ম্যানুয়েলের গবেষণার সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘ম্যানুয়েল তার বইতে বলতে চেয়েছেন, নেটওয়ার্কের কারণে আমরা একটা ভার্চুয়াল জগতে বাস করছি। ধীরে ধীরে যা হচ্ছে তা হলো নেট বনাম ব্যক্তিজীবন। মানুষ সমাজে একা হয়ে যাচ্ছে।’
কম্পিউটার ইন হিউম্যান বিহেভিয়ার সাময়িকীর জুলাই ২০১৪ সংখ্যায় এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেসবুক, টুইটার বা এরকম মাধ্যমগুলোতে বেশি সময় দেওয়া মানুষেরা দাম্পত্যজীবনে অসুখী হতে পারেন। এমনকি বিয়ে বিচ্ছেদের কথাও ভাবতে পারেন।’ তাই বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন বাস্তব জীবনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করার বিষয়ে।
বাংলাদেশেও যে বেশিরভাগ মানুষ সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক সময় কাটাচ্ছেন তার একটা হিসাব পাওয়া যায় ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিমের তথ্যে। তিনি জানান, দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারে ৮৮ গিগার মতো ব্যান্ডউইথ খরচ ব্যবহার হয়। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা প্রায় সারাক্ষণই ফেসবুক, মেসেঞ্জারে লগইন অবস্থায় থাকেন।
এছাড়া মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোও ব্যবহার হওয়া (১১০ গিগা) ব্যান্ডউইথের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবহার হয় ফেসবুওক। আর আইএসপিগুলোর গ্রাহকদের ব্যবহার হওয়া (৩২৬ গিগা) ব্যান্ডউইথের মধ্যে ১০ শতাংশ তথা ৩২ দশমিক ৬ গিগা ব্যবহার হয় ফেসবুক ব্যবহারে। এছাড়া অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সবমিলিয়ে ব্যান্ডউইথ খরচের পরিমাণ ১০০ গিগার বেশি। সূত্র : বাংলাট্রিবিউন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন