মুজিব থেকে যাত্রা শুরু হয়ে সজীবের কাছে

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১-এর গাজীপুরের প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশন ‘সজীব ওয়াজেদ উপগ্রহ ভূকেন্দ্র’ উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স সেন্টার থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গাজীপুরের এ উপকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। একই সঙ্গে তিনি বেতবুনিয়ার ব্যাক-আপ গ্রাউন্ড স্টেশন ‘সজীব ওয়াজেদ উপগ্রহ ভূকেন্দ্র’টিও উদ্বোধন করেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তেলীপাড়ায় টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজের কাছে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১-এর গ্রাউন্ড স্টেশন এবং বেতবুনিয়ার ব্যাক-আপ গ্রাউন্ড স্টেশন দুটি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাজীপুরের ও বেতবুনিয়ার সজীব ওয়াজেদ উপগ্রহ ভূকেন্দ্র উদ্বোধনকালে ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, ১৯৭৪ সালে ১৪ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সে পদাঙ্ক অনুসরণ করে, আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করতে পেরেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুজিব থেকে যাত্রা শুরু হয়ে এখন আমরা সজীবের কাছে পৌঁছেছি। আমি বিশ্বাস করি, মহাকাশে আমরা পৌঁছে গেছি। বাংলাদেশের জনগণ এর সুফল ভোগ করবে। বাংলাদেশের জনগণ এর সব আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। জাতির পিতা ৭ মার্চের ভাষণে যেকথা বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। তাই কেউ আমাদের আর দাবায়ে রাখতে পারবে না।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন।

এ সময় অনুষ্ঠানে গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কে এম আলী আজম, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আবদুল্লাহ আল মামুন, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান, গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারউজ্জামান, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রাহাতুল ইসলাম, গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান উপস্থিত ছিলেন।

পরে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে এ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। একই সঙ্গে বেতবুনিয়ার ব্যাক-আপ গ্রাউন্ড স্টেশনটিও উদ্বোধন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে গাজীপুরের উপগ্রহ কেন্দ্রের প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান রনি বক্তব্য দেন।

এ প্রসঙ্গে গ্রাউন্ড স্টেশন নেটওয়ার্ক অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের মিশনের ইঞ্জিনিয়ার ও ম্যানেজার মো. মোনতাসিরুর রহমান জানান, মহাকাশে নির্বিঘ্নে উৎক্ষেপণের পর স্যাটেলাইটটি এখন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে সংকেত দিচ্ছে ও নিচ্ছে। স্যাটেলাইটটি থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে সার্বক্ষণিক ওই স্যাটেলাইটটির গতিবিধি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার সমস্যা দেখা দেয়নি। এখান থেকে ট্র্যাকিং ও কন্ট্রোলিংয়ের কাজ হচ্ছে। ফুল সিস্টেমটিকে টেস্টিং করা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব টেস্ট ও ট্র্যাকিংয়ের কাজ সফলভাবে সমাপ্তির পর যে কোনো সময় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ কমার্শিয়াল অপারেশনে (বাণিজ্যিক কার্যক্রম) যাবে।

স্যাটেলাইট অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের স্যাটেলাইট ইঞ্জিনিয়ার নাসিরুজ্জামান রনি বলেন, এটা হলো কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। এর গ্রাউন্ড স্টেশনে হিউজ সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে। এখানে ভেতরে স্থাপিত আলাদা আলাদা ইকুইপমেন্ট ছাড়াও বাইরের পুরো সিস্টেমটিকে ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেস্ট করা হবে। বেতবুনিয়া এবং গাজীপুরে গ্রাউন্ড স্টেশনের ভেতরে ও বাইরে যত যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়েছে যেমন অ্যান্টেনা, নেটওয়ার্কিং সিস্টেমসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট ছোট ছোট ভাগ করে টেস্টিং করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গ্রাউন্ড স্টেশন ও অ্যান্টেনা টেস্ট করা শেষ হয়ে গেছে। এগুলো এখন পারফেক্টলি ফাংশনাল। এখন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বিভিন্ন প্রসেসে স্যাটেলাইট টেস্ট করা হচ্ছে। বর্তমানে গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনে বাংলাদেশি ৩০ জন ও ফ্রান্সের ১০ জনের মতো ফ্রান্সের প্রকৌশলী সার্বক্ষণিক কাজ করছেন।

প্রকল্পের পরিচালক মো. মেসবাহুজ্জামান জানান, উৎক্ষেপণের পর নির্দিষ্ট দূরত্বে দ্রাঘিমাংশে (প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে ১১৯.১পূর্ব দ্রাঘিমাংশে) স্যাটেলাইটটি অবস্থান করছে। ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স-ইতালি থেকে স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণভাবে কন্ট্রোল করা হলেও বর্তমানে গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ট্র্যাকিং এবং কন্ট্রোলিং করা হচ্ছে। প্রকৌশলীরা এখান থেকে স্যাটেলাইটে সিগন্যাল পাঠিয়ে আবার তা রিসিভ করছে এবং এসব অ্যানালাইসিস করছে। প্রয়োজন হলে সিগন্যাল পাঠিয়ে স্যাটেলাইটটিকে (১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পজিশনে) নির্দিষ্ট অবস্থনে ধরে রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা করছে। এখান থেকে নিয়মিত ট্র্যাকিং ও কন্ট্রোলিং করা হচ্ছে। ট্র্যাকিংয়ের আন্ডারে অনেক অ্যানালাইসিস আছে। কন্ট্রোলিংয়ের সঙ্গেও অনেক বিষয় আছে। স্যাটেলাইট সিগন্যাল যেটা পাঠায় ওটা আমরা রিসিভ করি। ওই সিগন্যাল দিয়ে আমরা তা চেক করি। পরে ওই সিগন্যালের উপর বেসিস করে আবার সিগনাল পাঠিয়ে স্যাটেলাইটটিকে কন্ট্রোল করা হয়। এখনও ফুল সিস্টেমটিকে টেস্ট করা হচ্ছে, আমরা যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে ওটা ফাংশনাল কিনা তা দেখা হচ্ছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। এভাবে ফুল টেস্ট শেষ করতে হয়ত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।

ম্যানেজার মো. মোনতাসিরুর রহমান জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে পৃথক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। যার নাম হলো বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল)। এ উপগ্রহের পরিষেবা নিতে ইতোমধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গত ৮ জুলাই বিসিএসসিএলর একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এ ছাড়া এর সেবা নিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে বিসিএসসিএল। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে তারা প্রস্তাবও পেয়েছে। আমরা যথাসময়ে কমার্শিয়াল অপারেশনে যাচ্ছি।

কনসালট্যান্ট এস এম নুসরাত দস্তগীর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে গত ১২ মে বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিটে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি হলো কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ভি-স্যাট ও বেতারসহ ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবেশ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ই-সেবা নিশ্চিত করবে।

এ ছাড়া আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-রিসার্চ, ভিডিও কনফারেন্স প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভালো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। এটির অবস্থান প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার উপরে।