যুক্তরাষ্ট্রে কেন এত বন্দুক হামলা? | সুলতানা স্বাতী
বিশ্বজুড়ে যখন পালন হচ্ছে ভ্যালেন্টাইন ডে, তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ড এলাকায়। বুধবার অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর আড়াইটায় পার্কল্যান্ডের মার্জরি স্টোনম্যান ডগলাস হাই স্কুলে অতর্কিতে হামলা চালায় ওই স্কুলেরই এক সাবেক ছাত্র। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে স্কুলের শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১৭ জন। মিয়ামি থেকে ৭২ কিলোমিটার উত্তরের ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা তখন অপেক্ষা করছিল বাড়ি ফেরার। কিন্তু তারা জানে না উৎসবের আনন্দ নয়, কান্না নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তাদের। হামলাকারী নিকোলাস ক্রুজ একটি অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে তারই কয়েকজন সহপাঠীকে। ফায়ার এলার্ম বাজিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে হলওয়েতে আসতে বাধ্য করে সে। তারপরই চালায় গুলি। মাত্র ১৯ বছর বয়স তার। কিন্তু কেন এই হত্যাকা-? এর কারণ আর কিছুই না। প্রায়ই স্কুলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতো বলে বছর খানেক আগে বহিষ্কার করা হয় ক্রুজকে। তারই প্রতিশোধ নিলো সে এভাবে!
তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে হামলার ঘটনা নতুন নয়। প্রায়ই সেখানে স্কুলে হামলা হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এভরিটাউন ফর গান সেফটি, তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ২৯১টি বন্দুক হামলা হয়েছে শুধু স্কুলে। অর্থাৎ অন্তত এক সপ্তাহে একটি করে হামলা হয়েছে। তবে ২০১২ সালে কানেকটিকাটের নিউটাউনে স্যান্ডি হুক প্রাইমারি স্কুলে বন্দুক হামলার ঘটনার পর, এই হামলাকেই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর নৃশংস বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বছর এ নিয়ে স্কুলে হামলা হলো অন্তত ছয়বার। আর হামলার সংখ্যা ১৮টি। মাত্র দেড় মাসে বা ৪৫ দিনে ১৮টি হামলা! অর্থাৎ আড়াই দিনে একটি হামলা!
বছরের শুরুর দিকেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আবারো নড়েচড়ে বসেছে মার্কিনরা। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ। সবচেয়ে নিরাপদ দেশ। অনেকের কাছে স্বপ্নের দেশ। আর সেই দেশেই প্রায় প্রতিদিনই ঘটে কোনো না কোনো হামলার ঘটনা! অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি দু মাস পর পর সেখানে একটি বড় ধরনের বন্দুক হামলা বা গণহত্যার ঘটনা ঘটে। আর এ ধরনের হামলায় ২০১৭ সালে ৩৪৬ জন নিহত হয়েছে। ২০১৬ সালে ৪৩২ জন এবং ২০১৫ সালে ৩৬৯ জন। ম্যাস স্যুটিং আর্কাইভের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে সেখানে ৩৫টি বড় ধরনের গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ একদিনে একটির বেশি। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ২৭টি, মার্চে ৩৬টি, এপ্রিলে ৩৮টি, মে মাসে ২৭টি, জুনে ৪৪টি, জুলাইয়ে ২৬টি, আগস্টে ২৭টি, সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৮৬টি, নভেম্বরে ২৮টি গণহত্যার ঘটনা ঘটে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাÑএফবিআইয়ের জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে যারা একা থাকে তারাই বন্দুক রাখে বেশি। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে যে, তাদের কাছে বন্দুক রয়েছে এবং তারা একা থাকে। বিশ্বের শক্তিশালী কয়েকটি দেশের মধ্যে বন্দুক হামলার তুলনা করে ভয়াবহ তথ্য পেয়েছে এফবিআই। দেখা গেছে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা সংক্রান্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৬৪ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে ইংল্যান্ডে এই সংখ্যা ৪.৫ শতাংশ, কানাডায় ২০১৫ সালে ৩০.৫ শতাংশ এবং অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৩-১৪ সালে ১৩ শতাংশ বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, গোটা পৃথিবীতে যত মানুষ বাস করে, তার মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ বাস করে যুক্তরাষ্ট্রে। আর সেখানে গণহত্যার ঘটনা ঘটে ৩১ শতাংশের বেশি। জরিপ অনুযায়ী, ১৯৬৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৯০টির বেশি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গণহত্যা হলো সেই হত্যাকা-, যেখানে চার বা তার বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়, যারা একই পরিবারভুক্ত নয়।
আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর অ্যাডাম ল্যাঙ্কফোর্ড গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া হামলা গণহত্যাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গণহত্যাগুলোর সাথে বিশ্বের ১৭১টি দেশের গণহত্যার মধ্যে তুলনা করে কিছু বিষয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য পেয়েছেন তিনি। তার গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বেশিরভাগ হত্যাকা- ঘটে স্কুলে অথবা কর্মক্ষেত্রে। আর অন্যান্য দেশে হত্যাকা- ঘটে সামরিক ক্যাম্প বা স্থাপনাগুলোর আশপাশে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধেকের বেশি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে হামলাকারী একের অধিক অস্ত্রের মালিক। অপরদিকে অন্য দেশগুলোতে হামলাকারী একটি মাত্র অস্ত্র দিয়েই হামলা চালায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে হামলায় নিহতদের সংখ্যা তুলনামূলক কম হয়। সেখানে প্রতিটি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৬.৮৭ । আর অন্য দেশগুলোতে এ সংখ্যা ৮.৮।
এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন ল্যাঙ্কফোর্ড। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ নিয়মিতভাবেই নাগরিকদের হত্যাকাণ্ড বা হামলা থেকে বাঁচার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, নাগরিকদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দেয় পুলিশ। এছাড়া যেকোনো হত্যাকা-, হামলা বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় অন্য দেশগুলোর তুলনায় মার্কিন পুলিশ দ্রুত সাড়া দেয় বলে জানিয়েছেন ল্যাঙ্কফোর্ড। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে হামলা বেশি হলেও নিহতের সংখ্যা কম।
অন্য দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের সংখ্যাও বেশি। ২০০৭ সালে স্মল আর্মস সার্ভে নামের একটি প্রতিষ্ঠান এক জরিপ করে। ওই জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ওই সময়ে মোট ৩২ কোটি জনসংখ্যার বসবাস। এই ৩২ কোটি মানুষের মধ্যে বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে প্রায় ৩১ কোটি। অর্থাৎ প্রত্যেক আমেরিকানের কাছে অন্তত একটি অস্ত্র রয়েছে। আর এই ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্রের সহজলভ্যতাকেই দায়ী করেছেন ল্যাঙ্কফোর্ড।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র এত সহজলভ্য কেন? অবৈধভাবে নয়, বৈধভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ অস্ত্র রাখতে এবং বহন করতে পারে। আর জনগণকে এই অধিকার দিয়েছে দেশটির সংবিধান। ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়া কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৭৯১ সালে দশটি সংশোধনী সংবলিত ‘বিল অব রাইটস’ নাগরিকদের একাধিক মৌলিক নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এর মধ্যে ছিল অস্ত্র রাখা, বহন করা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করার অধিকার, যা ‘দ্বিতীয় সংশোধনী’ নামে পরিচিত। গৃহীত হয়েছিল ১৭৯১ সালের ১৫ ডিসেম্বর।
শুধু তাই নয়, অস্ত্র রাখার বিষয়টিকে আমেরিকানরা ঐতিহ্য বলেও মনে করে। স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘ সময় দেশটিতে শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শক্তিশালী পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে সারা দেশের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই সুযোগে অনেক অপরাধী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তাদের রুখতে এবং নাগরিকদের নিজের নিরাপত্তা নিজেরই নিশ্চিত করতে অস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।
এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার যাতে কোনোদিন সাধারণ নাগরিকের ওপর অত্যাচারী শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে না পারে, সে জন্য সাধারণ নাগরিকদের ছোটখাটো সামরিক বাহিনী বা মিলিশিয়া গঠনের অনুমতি দেওয়া আছে সংবিধানে। দেশটিতে কয়েকজন মানুষ একত্রিত হয়ে অস্ত্র ও সেনা সদস্যের পোশাক কিনে সেনাবাহিনীর মতো প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। তবে কি ধরনের অস্ত্র তারা রাখতে পারবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতে। আর প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে সরকারিভাবেই।
আরও একটি কারণ রয়েছে অস্ত্র রাখার। যুক্তরাষ্ট্রে বহু বড় বড় রাজ্যের শহরের বাইরে বহু ধনী কৃষক বা খামারি বসবাস করে। খামারিদের আবার কিছু কাউবয়ও থাকে যারা গৃহস্থের গৃহপালিত পশুগুলোর দেখাশোনা করে। বিস্তীর্ণ এলাকায় একটি মাত্র বাড়িতে এই কৃষক বা খামারিদের বসবাস। তো এই কৃষক বা খামারিদের বাড়িতে যাতে ডাকাত না ঢুকে কিংবা খামারে কোনো হিংস্র জন্তু যেমনÑনেকড়ে বা হায়েনা আক্রমণ করতে না পারে সেজন্যই মূলত অস্ত্র রাখা ও বহনের অধিকার দেওয়া হয়। কৃষক বা খামারিই শুধু নয় কাউবয়দেরও রয়েছে অস্ত্র রাখার অধিকার।
কিন্তু কথা হচ্ছে, যখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য এই বিধান করা হয়েছিল, তখনকার বাস্তবতা আর এখনকার পরিস্থিতি কি এক? বিশেষ করে বর্তমান এই সভ্য সমাজে, সভ্য দেশে? সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ কারণেই বেশ কয়েকবার অস্ত্র আইনে পরিবর্তন ও সংশোধনী আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তবে কঠোর অস্ত্র আইন আসলেই হত্যাকা- বা হামলার ঘটনা কম ঘটায় বলে জানিয়েছেন ল্যাঙ্কফোর্ড। এর একটি উদাহরণ হলো অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে চারটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর সেখানে অস্ত্র আইন আরও কঠোর করার দাবি ওঠে। পরে পার্লামেন্টে কঠোর অস্ত্র আইন পাস হয়। তখন থেকে অস্ট্রেলিয়াতে ছোটখাটো হামলা বা সহিংসতা হলেও আর একটিও গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি।
লেখকঃ সুলতানা স্বাতী, সাংবাদিক
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন